নাযিল হওয়ার সময়-কাল ও এর কারণসমূহ
এ সূরার বিষয়বস্তু থেকে একথা বুঝা যাচ্ছে যে, এটিও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কায় অবস্থানের শেষ যুগে নাযিল হয়ে থাকবে। তখন কুরাইশের লোকেরা নবীকে (সা) হত্যা বা দেশান্তর করবে, না বন্দী করবে, এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিল। এ সময় মক্কার কাফের সমাজের কোন কোন লোক (সম্ভবত ইহুদীদের ইংগিত) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পরীক্ষা করার জন্য তাঁকে প্রশ্ন করে, বনী ইসরাঈলরা কি কারণে মিসরে চলে গিয়েছিল? যেহেতু আরববাসীরা এ ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানতো না, তাদের কথা-কাহিনী ও পৌরানিক বৃত্তান্তসমূহে কোথাও এর কোন উল্লেখই পাওয়া যেতো না এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের মুখেও ইতিপূর্বে এ সম্পর্কিত কোন কথা শোনা যায়নি, তাই তারা আশা করছিল, তিনি এর কোন বিস্তারিত জবাব দিতে পারবেন না অথবা এ সময় টালবাহানা করে কোন ইহুদীকে জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করবেন এবং এভাবে তাঁর বুজরুকি ধরা পড়ে যাবে। কিন্তু এ পরীক্ষায় উলটো তারাই মার খেয়ে গেলো। আল্লাহ কেবল সংগে সংগেই ইউসুফ আলাইহি সালামের এ ঘটনা সম্পূর্ণ তাঁর মুখ দিয়ে শুনিয়েই ক্ষান্ত হলেন না বরং এ ঘটনাকে কুরইশরা ইউসুফের ভাইদের মতো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে যে ব্যবহার করছিল ঠিক তার সদৃশ ঘটনা হিসেবে উপস্থাপিত করলেন।
নাযিলের উদ্দেশ্য
একঃ এর মাধ্যমে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের প্রমাণ এবং তাও আবার বিরোধীদের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা। এ সংগে তাদের স্থিরীকৃত পরীক্ষায় একথা প্রমাণ করে দেয়া যে, নবী শোনা কথা বলেন না বরং অহীর মাধ্যমে যথার্থ জ্ঞান লাভ করেন। ৩ ও ৭ আয়াতে এ উদ্দেশ্যটি সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে এবং ১০২ ও ১০৩ আয়াতে পূর্ণ শক্তিতে এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
দুইঃ কুরাইশ সরদারদের ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যে এ সময় যে দ্বন্দ্ব চলছিল তার ওপর ইউসুফ আলাইহিস সালামের ভাইদের ঘটনা প্রয়োগ করে কুরাইশদেরকে একথা জানিয়ে দেয়া যে, আজ তোমরা নিজেদের ভাইয়ের সাথে ঠিক তেমনি আচরণ করছো যেমন ইউসূফের ভাইয়েরা তাঁর সাথে করেছিলেন। কিন্তু যেমন তারা আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে লড়াই করে সফল হয়নি এবং শেষ পর্যন্ত যাকে চরম নির্দয়ভাবে কূয়ার মধ্যে ফেলে দিয়েছিলো সেই ভায়ের পদতলেই নিজেদের সঁপে দিতে হয়েছিল। ঠিক তেমনিভাবে আল্লাহর কৌশল ও ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে তোমাদের শক্তি প্রয়োগ সফল হতে পারবে না। একদিন তোমাদেরও নিজেদের এ ভাইয়ের কাছে দয়া ও অনুগ্রহ ভিক্ষা করতে হবে, যাকে আজ তোমরা খতম করে দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছো। সূরার শুরুতে এ উদ্দেশ্যটিও পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছেঃ
(আরবী)
“ইউসুফ ও তার ভাইদর ঘটনার মধ্যে এ প্রশ্নকারীদের জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে।”
আসলে ইউসুফ আলাইহিস সালামের ঘটনাকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও কুরাইশদের দ্বন্দের ওপর প্রয়োগ করে কুরআন মজীদ যেন একটি স্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। পরবর্তীকালের ঘটনাবলী তাকে অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণ করেছে। এ সূরাটি নাযিল হওয়ার দেড় দু’বছর পরই কুরাইশরা ইউসুফের ভাইদের মতো মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। তাদের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাবার জন্য তাঁকে বাধ্য হয়ে মক্কা থেকে বের হতে হয়। তারপর তাদের প্রত্যাশার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধেই দেশান্তরী অবস্থায়ই তিনি ঠিক তেমনি উন্নতি ও কর্তৃত্ব লাভ করেন যেমন ইউসুফ আলাইহিস সালাম করেছিলেন। তারপর মক্কা বিজয়ের সময় ঠিক সেই একই ঘটনা ঘটেছিল যা মিসরের রাজধানীতে ইউসুফ আলাইহিস সালামের সামনে তাঁর ভাইদের শেষ উপস্থিতির সময় ঘটেছিল। সেখানে যখন ইউসুফের ভাইয়েরা চরম অসহায় ও দীন হীন অবস্থায় তাঁর সমনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে বলছিলেনঃ
(আরবী)
“আমাদের প্রতি সাদকা করুন। আল্লাহ সাদকাকারীদেরকে উত্তম পুরস্কার দিয়ে থাকেন।”
তখন ইউসুফ আলাইহিস সালাম প্রতিশোধ নেবার শক্তি রাখা সত্ত্বেও তাদেরকে মাফ করে দিলেন এবং বললেনঃ
(আরবী)
“আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদের মাফ করে দিন। তিনি সকল অনুগ্রহকারীর চাইতে বড় অনুগ্রহকারী।”
অনুরূপভাবে এখানে যখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে পরাজিত বিধ্বস্ত কুরাইশরা মাথা নত করে দাঁড়িয়েছিল এবং তিনি তাদের প্রত্যেকটি জুলুমের বদলা নেবার ক্ষমতা রাখতেন তখন তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “তোমরা কি মনে করো, আমি তোমাদের সাথে কেমন ব্যবহার করবো?” তারা জবাব দিলঃ (আরবী) “আপনি একজন উদারচেতা ভাই এবং একজন উদারচেতা ভাইয়ের সন্তান।” একথায় তিনি বললেনঃ
(আরবী)
“আমি তোমাদের সেই একই জবাব দিচ্ছি যে জবাব ইউসুফ তার ভাইদেরকে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। যাও তোমাদের মাফ করে দিলাম।”
বিষয়বস্তু ও আলোচ্য বিষয়
এ দু’টি বিষয় তো এ সূরা উদ্দেশ্যের পর্যায়ভুক্ত। কিন্তু এ কাহিনীটিকেও কুরআন মজীদ নিছক গল্প বলার ও ইহিতাস লেখার ঢংয়ে বর্ণনা করছে না বরং নিজের রীতি অনুসারে তাকে মূল দাওয়াত প্রচারে ব্যবহার করছে।
এ পুরো ঘটনাটিতে সে একথা সুস্পস্ট করে তুলে ধরছে যে, হযরত ইবরাহীম (আ) হযরত ইসহাক (আ), হযরত ইয়াকুব (আ) সেই একই দীনের অনুসারী ছিলেন যে দীনের অনুসারী ছিলেন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং যে দাওয়াত তিনি দিচ্ছেন সেই একই দাওয়াত তাঁরাও দিতেন।
তাছাড়া সে একদিকে হযরত ইয়াকুব ও হযরত ইউসুফের কর্মকাণ্ড ও চরিত্র এবং অন্যদিকে ইউসুফের ভ্রাতৃবৃন্দ, বণিক দল, আযীযে মিসর, তার স্ত্রী, মিসরের অভিজাত পরিবারের নারী সমাজ ও শাসকদের কর্মকাণ্ড ও চরিত্র পরম্পদের মোকাবিলায় তুলে ধরছে এবং নিছক নিজের বর্ণনাভংগীর মাধ্যমে শ্রোতা ও পাঠকদের সামনে এ নীরব প্রশ্ন উপস্থাপন করছে যে, দেখো, একদিকে ইসলাম একটি আদর্শ চরিত্র পেশ করছে। আল্লাহর বন্দেগী ও আখেরাতে জবাবদিহির প্রতি বিশ্বাসের ভিত্তিতেই এ চরিত্র গড়ে উঠে। আবার অন্যদিকে রয়েছে আর একটি চরিত্র। কুফরী, জাহেলিয়াত, বৈষয়িক স্বার্থপূজা ও আখেরাতের সাথে সম্পর্কহীনতার ছাঁচে ঢালাই হয়ে এ চরিত্র তৈরী হয়। এখন তোমরা নিজেদের বিবেককে জিজ্ঞেস করো, সে এর মধ্য থেকে কোন চারিত্রিক আদর্শটি পছন্দ করে?
তারপর এ ঘটনা থেকে কুরআন মজীদ আরো একটি গভীর তত্ত্বও মানুষের হৃদয়পটে অংকন করে দেয়। সেটি হচ্ছে, আল্লাহ যে কাজ করতে চান তা যে কোন অবস্থায় সম্পাদিত হয়েই যায়। মানুষ নিজের বুদ্ধিমত্তা ও কলাকৌশলের মাধ্যমে তাঁর পরিকল্পনা প্রতিহত করার বা বদলাবার ব্যাপারে কখনো সফল হতে পারে না। বরং অনেক সময় মানুষ নিজের পরিকল্পনার লক্ষে একটি কাজ করে এবং মনে করতে থাকে যে, সে তীরটি ঠিক নিশানায় মেরে দিয়েছে কিন্তু শেষে প্রমাণ হয় যে, আল্লাহ তারই হাত দিয়ে এমন কাজ করিয়ে নিয়েছেন যা ছিল তার নিজের পরিকল্পনার বিরোধী এবং আল্লাহর পরিকল্পনার পুরোপুরি বাস্তবায়ন। ইউসুফ আলাইহি সালামের ভাইয়েরা যখন তাঁকে কূয়ায় ফেলে দিচ্ছিল তখন তারা মনে করছিলো আমরা নিজেদের পথের কাঁটা চিরতরে দূর করে দিচ্ছি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা ইউসুফকে নিজেদের হাতে এমন এক উন্নতির প্রথম ধাপে চড়িয়ে দিয়েছিলো যার ওপর আল্লাহ তাঁকে চড়াতে চাচ্ছিলেন এবং এ কাজ করে তারা নিজেরা যে ফল লাভ করেছে তা এ ছাড়া আর কিছু নয় যে, ইউসুফের উন্নতির উচ্চ শিখরে পৌঁছে যাবার পর তারা নিজের ভাইয়ের সাথে সসম্মানে সাক্ষাত করতে যাওয়ার পরিবর্তে লজ্জা ও অনুতাপের অনুভূতি সহকারে মাথা নত করে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। আযীযে মিসরের স্ত্রী ইউসুফকে কারাগারে পাঠিয়ে মনে করছিল সে প্রতিশোধ নিচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে তার জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পৌঁছার পথ পরিষ্কার করেছিল। আর নিজের এ কৌশলের মাধ্যমে সে নিজের জন্য এর চেয়ে বেশী কিছু অর্জন করতে পারেনি যে, যথার্থ কাজের সময়ে দেশের শাসকের স্ত্রী হিসেবে ‘মুরব্বী’র সম্মান লাভ করার পরিবর্তে তাকে নিজের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য লজ্জায় অধোবদন হতে হয়। এসব নিছক দু’চারটে বিছিন্ন ঘটনা নয়। বরং ইতিহাসের পাতা এমনি ধরনের অসংখ্য ঘটনায় ভরা। এগুলো এ সত্যটিরই সাক্ষ প্রদান করে যে, আল্লাহ যাকে ওপরে উঠাতে চান সারা দুনিয়ার লোকেরা মিলেও তাকে নিচে ফেলে দিতে পারে না। বরং দুনিয়ার লোকেরা তাকে নিচে ফেলে দেয়ার জন্য যে কৌশলটি অত্যন্ত কার্যকর ও নিশ্চিত মনে করে অবলম্বন করে সেই কৌশলের মধ্য দিয়েই আল্লাহ তার ওপরে ওঠার পথ বের করে দেন এবং যারা তাকে নামাতে চেয়েছিল তাদের জন্য লাঞ্ছনা ও অপমান ছাড়া আর কিছুই থাকে না। অনুরূপভাবে এর ঠিক বিপরীতে আল্লাহ যাকে ভূপাতিত করতে চান কোন কৌশলই তাকে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারে না। বরং দাঁড় করিয়ে রাখার যাবতীয় কার্যক্রম ও কৌশল উলটে যায় এবং এ ধরনের কৌশল অবলম্বনকারীকে ব্যর্থ মনোরথ হতে হয়।
যে ব্যক্তি এ সত্যটি উপলব্ধি করবে সে প্রথমে এ শিক্ষা লাভ করবে যে, মানুষকে নিজের উদ্দেশ্য ও কলাকৌশল উভয় ক্ষেত্রে এমন সব সীমারেখা অতিক্রম করা উচিত নয় যা আল্লাহর আইনে তার জন্য নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে। সাফল্য ও ব্যর্থতা অবশ্যি আল্লাহর হাতে। কিন্তু যে ব্যক্তি পবিত্র উদ্দেশ্যে সরল সোজা ও বৈধ কলাকৌশল অবলম্বন করবে সে ব্যর্থ হয়ে গেলেও তাকে লাঞ্ছনা ও অপমানের সম্মুখীন হতে হবে না। আর যে ব্যক্তি অপবিত্র উদ্দেশ্যে বাঁকা কলাকৌশল অবলম্বন করবে সে আখেরাতে তো অবশ্যি অপমানিত ও লাঞ্ছিত হবেই, দুনিয়াতেও তার জন্য অপমান ও লাঞ্ছনার ভয় কিছু কম নেই। দ্বিতীয়ত সে এ থেকে লাভ করবে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল এবং তাঁর প্রতি আত্মসমর্পিত হবার গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। যারা সত্য ও সততার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং দুনিয়াবাসীরা তাদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে তারা যদি এ সত্যটি সামনে রাখে তাহলে এ থেকে তারা দুর্লভ মানসিক প্রশান্তি লাভ করবে এবং বিরোধী শক্তিবর্গের বাহ্যত অত্যন্ত ভয়াবহ কলাকৌশলসমূহ দেখে তারা মোটেই ভীত হবে না। বরং ফলাফল আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়ে নিজেদের নৈতিক দায়িত্ব পালন করে যেতে থাকবে।
কিন্তু এ ঘটনাটি থেকে সবচেয়ে বড় যে শিক্ষটি পাওয়া যায় সেটি হচ্ছে এই যে, একজন মরদে মুমিন যদি সত্যিকার ইসলামী চরিত্রের অধিকারী হয় এবং সে বিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতার গুণেও গুণান্বিত হয় তাহলে নিছক নিজের চরিত্র বলে সে সারা দেশ জয় করতে পারে। ইউসুফ আলাইহিস সালামের ব্যাপারটি দেখুন। ১৭ বছর বয়সে একাকী সহায় সম্বলহীন অবস্থায় বিদেশ বিভূঁইয়ে তিনি একেবারেই অপরিচিত পরিবেশে, অধিকন্তু চরম দুর্বল অবস্থায় নিপতিত। কারণ তাঁকে গোলাম বানিয়ে বিক্রি করা হয়। ইতিহাসের সেই অধ্যায়ে গোলামদের যে অবস্থা ছিল তা কারো অজানা নেই। এর ওপর মরার ওপর খাঁড়ার ঘা স্বরূপ একটি মারাত্মক নৈতিক অপরাধে অভিযুক্ত করে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। এখানে শাস্তির কোন মেয়াদ নির্ধারিত হয়নি। এভাবে তাঁকে একেবারে চরম পর্যায়ে নামিয়ে দেবার পরও তিনি নিছক নিজের ঈমান ও চরিত্র বলে উঠে দাঁড়ান এবং শেষ পর্যন্ত সারা দেশের ওপর বিজয়ী হন।
ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক অবস্থা
এ ঘটনাটি সঠিকভাবে বুঝাতে হলে এ সম্পর্কে কিছু সংক্ষিপ্ত ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক তথ্য পাঠকদের সামনে থাকা উচিত।
হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম ছিলেন হযরত ইয়াকূবের (আ) পুত্র, হযরত ইসহাকের পৌত্র এবং হরত ইবরাহীমের প্রপৌত্র। বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী (কুরাআনের ইংগিত থেকে এর সমর্থন পাওয়া যায়) হযরত ইয়াকূবের চার স্ত্রী থেকে ছিল বারটি ছেলে। হযরত ইউসুফ (আ) ও বিন ইয়ামীন ছিলেন এক স্ত্রীরর গর্ভজাত এবং বাকি দশজন অন্য স্ত্রীদের গর্ভজাত।
ফিলিস্তিনে হযরত ইয়াকূবের আবার ছিল হিবরূন (বর্তমান আল খাইল) উপত্যকায়। এখানে হযরত ইসহাক (আ) এবং তাঁর পূর্বে হযরত ইবরাহীমও (আ) থাকতেন। এ ছাড়া সিককিমে (বর্তমানে নাবলুস) হযরত ইয়াকূবের (আ) কিছু জমি ছিল।
বাইবেল বিশারদগণের গবেষণাকে সঠিক বলে ধরে নিলে হযরত ইউসুফের জন্ম খৃষ্টপূর্ব ১৯০৬ সালের কাছাকাছি সময়ে হয় বলে ধরা যায়। এ হিসেবে খৃষ্টপূর্ব ১৮৯০ সালের কাছাকাছি সময়ে যে ঘটনাটি ঘটে অর্থাৎ স্বপ্ন দেখা এবং কূয়ায় নিক্ষিপ্ত হওয়া, এ থেকে এ ঘটনাটির সূত্রপাত্র হয়। এ সময় হযরত ইউসুফের বয়স ছিল ১৭ বছর। যে কূয়ায় তাঁকে ফেলে দেয়া হয় সেটি বাইবেল ও তালমূদের ভাষ্যমতে সিককিমের উত্তর দিকে দূতান (বর্তমানে দূসান) নামক স্থানে কাছাকাছি অবস্থিত ছিল। আর যে কাফেলাটি তাঁকে কূয়া থেকে উদ্ধার করে তারা জাল’আদ (পূর্ব জর্দান) থেকে আসছিল এবং মিসরের দিকে যাচ্ছিল। (জাল’আদের ধ্বংসাবশেষ আজো জর্দান নদীর পূর্ব দিকে ইলিয়াবিস উপত্যকার কিনারে পাওয়া যায়।
এ সময় মিসরে পঞ্চদশতম রাজ পরিবারের শাসন চলছিল। মিসরের ইতিহাসে এ পরিবারটি রাখাল রাজন্যবর্গ (HYKSOS KINGS) নামে পরিচিত। এরা ছিল আরবীয় বংশজাত। খৃষ্টপূর্ব দু’হাজার বছরের কাছাকাছি সময়ে এরা ফিলিস্তিন ও সিরিয়া থেকে মিসরে গিয়ে দেশের শাসন কর্তৃত্ব দখল করেছিল। আরব ঐতিহাসিক ও কুরআনের তাফসীরকারগণ তাদের জন্য “আমালীক” নাম ব্যবহার করেছেন। মিসর সম্পর্কীয় আধুনিক অনুসন্ধান ও গবেষণার সাথে এটি পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল। মিসরে এরা বিদেশী হানাদারের পর্যায়ভুক্ত ছিল এবং দেশে গৃহবিবাদের কারণে তারা যেখানে নিজেদের রাজত্ব কায়েম করার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল। এ কারণে তাদের রাজত্বে হযরত ইউসুফের (আ) উত্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল এবং তারা বনী ইসরাঈলকে সাদরে গ্রহণ করেছিল। দেশের
হযরত ইউসুফ (আ)-এর কাহিনী সংক্রান্ত মানচিত্র
মানচিত্র ()
দুতনঃ বাইবেলের মতে এ স্থানেই হযরত ইউসুফ কূপে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল।
সিক্কিমঃ এখানে হযরত ইয়াকূবের পৈতৃক সম্পত্তি ছিল। বর্তমানে এর নাম নাবলূস।
হিবরুনঃ এখানে হযরত ইয়াকূব বসবাস করতেন। এর আর এক নাম ‘আল-খলীল।’
জুশানঃ হযরত ইউসুফ এখানে বনী ইরাঈলদেরকে পুনর্বাসিত করেন।
সবচেয়ে উর্বর এলাকা তাদের বসতি স্থাপন করার জন্য দেয়া হয়েছিল। সেখানে তারা বিপুল প্রভাব প্রতিপত্তির অধিকারী হয়েছিল। কারণ তারা ছিল বিদেশী শাসকদের সগোত্রীয়। খৃষ্টপূর্ব পঞ্চদশ শতকের শেষ অবধি তারা মিসর শাসন করতে থাকে। তাদের আমলে কার্যত দেশের যাবতীয় কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা বনী ইসরাঈলের হাতে ন্যস্ত থাকে। সূরা ময়েদার ২০ আয়াতে এ যুগের প্রতি ইংগিত করে বলা হয়েছেঃ
(আরবী)
এরপর দেশে একটি প্রবল জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সৃষ্টি হয়। এর ফলে হিক্সুস (HYKSOS) শাসনের অবসান ঘটে। আড়াই লাখের মতো আমালিকাকে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়। একটি চরম বিদ্বেষী কিব্তী বংশোদ্ভূত পরিবার দেশের শাসন কর্তৃত্ব দখল করে। তারা আমালিকাদের আমলের প্রত্যেকটি স্মৃতি চিহ্ন খুঁজে খুঁজে বের করে এনে ধ্বংস করে দেয় এবং হযরত মূসার (আ) ঘটনা প্রসংগে বনী ইসরাঈলদের প্রতি যেসব অত্যাচারের কাহিনী উল্লেখিত হয়েছে তার ধারাবাহিকতার সূত্রপাত করে।
মিসরের ইতিহাস থেকে একথাও জানা যায় যে, এ রাখাল বাদশাহরা মিসরীয় দেবতাদেরকে স্বীকৃতি দেয়নি। তারা সিরিয়া থেকে নিজেদের দেবতা সংগে করে এসেছিল। মিসরে নিজেদের ধর্মের প্রসারে তারা প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। এ করণে কুরআন মজীদ হযরত ইসুফের সমকালীন মিসর সম্রাটকে “ফেরাউন” নামে উল্লেখ করছে না। কারণ ফেরাউন ছিল মিসরের ধর্মীয় পরিভাষা এবং এরা মিসরীয় ধর্মের প্রবক্তা ছিল না। কিন্তু বাইবেলে ভুলক্রমে তাকেও “ফেরাউন” বলা হয়েছে। সম্ভবত বাইবেল সংকলকগণ মনে করতেন যে, মিসরের সব বাদশাহই “ফেরাউন” ছিল।
বর্তমান যুগের অনুসন্ধানী ও গবেষকগণ বাইবেল ও মিসরীয় ইতিহাসের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করছেন। তারা সাধারণভাবে এ অভিমত পোষণ করেন যে, মিসরের ইতিহাসে রাখাল বাদশাহদের মধ্যে আপোফিস (APOPHIS) নাকম বাদশাহই ছিলেন হযরত ইউসুফের সমসাময়িক।
এ সয়ম মমফিস (মনফ) ছিল মিসরের রাজধানী। কায়রোর দক্ষিণে ১৪ মাইল দূরে এর ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। হযরত ইউসুফ (আ) ১৭/১৮ বছর বয়সে সেখানে পৌঁছেন। দু’তিন বছর আযীযে মিসরের বাড়িতে থাকেন। আট নয় বছর কারাগারে বাস করেন। ৩০ বছর বয়সে দেশের শাসক নিযুক্ত হন। ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত একচ্ছত্রভাবে সমগ্র মিসর শাসন করতে থাকেন। তাঁর শাসনকালের নবম বা দশম বছরে তিনি হযরত ইয়কূবকে (আ) তাঁর সমগ্র পরিবার পরিজনসহ ফিলিস্তিন থেকে মিসরে নিয়ে আসেন। তাদেরকে দিমীয়াত ও কায়রোর মাঝামাঝি এলাকায় আবাদ করেন। বাইবেলে এ এলাকার নাম জুশান বা গুশান বলা হয়েছে। হযরত মূসার (আ) আমল পর্যন্ত তারা সেখানেই বসবাস করতো। বাইবেলের বর্ণনামতে হযরত ইউসুফ একশো দশ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন। মৃত্যুকালে তিনি বনী ইসরাঈলকে অসিয়াত করে যান, তোমরা যখন এ দেশ ত্যাগ করবে তখন আমার হাড়গুলো সংগে করে নিয়ে যাবে।
বাইবেলে ও তালমূদে ইউসুফ আলাইহিস সালামের ঘটনার যে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে কুরআনের বর্ণনা তা থেকে অনেকটা ভিন্নতর। কিন্তু ঘটনার গুরুত্বপূর্ণ অংশে তিনটি বর্ণনাই একাত্ম । আমার ব্যাখ্যা ও টীকাগুলোতে আমি প্রয়োজনমতো এ পার্থক্য সুস্পষ্ট করে যেতে থাকবো।
﴿بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ الر ۚ تِلْكَ آيَاتُ الْكِتَابِ الْمُبِينِ﴾
১) আলিফ-লাম-র৷ এগুলো এমন কিতাবের আয়াত যা নিজের বক্তব্য পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করে৷
﴿إِنَّا أَنزَلْنَاهُ قُرْآنًا عَرَبِيًّا لَّعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ﴾
২) আমি একে আরবী ভাষায় কুরআন বানিয়ে নাযিল করেছি, যাতে তোমরা (আরববাসীরা) একে ভালোভাবে বুঝতে পারো৷
﴿نَحْنُ نَقُصُّ عَلَيْكَ أَحْسَنَ الْقَصَصِ بِمَا أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ هَٰذَا الْقُرْآنَ وَإِن كُنتَ مِن قَبْلِهِ لَمِنَ الْغَافِلِينَ﴾
৩) হে মুহাম্মদ! আমি এ কুরআনকে তোমার কাছে অহীর মাধ্যমে পাঠিয়ে উত্তম পদ্ধতিতে ঘটনাবলী ও তত্ত্বকথা তোমার কাছে বর্ণনা করছি৷ নয়তো ইতিপূর্বে তুমি (এসব জিনিস থেকে) একেবারেই বেখবর ছিলে৷
﴿إِذْ قَالَ يُوسُفُ لِأَبِيهِ يَا أَبَتِ إِنِّي رَأَيْتُ أَحَدَ عَشَرَ كَوْكَبًا وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ رَأَيْتُهُمْ لِي سَاجِدِينَ﴾
৪) এটা সেই সময়ের কথা, যখন ইউসুফ তার বাপকে বললো : “আব্বাজান! আমি স্বপ্ন দেখেছি, এগারটি তারকা এবং সূর্য ও চাঁদ আমাকে সিজদা করছে৷”
﴿قَالَ يَا بُنَيَّ لَا تَقْصُصْ رُؤْيَاكَ عَلَىٰ إِخْوَتِكَ فَيَكِيدُوا لَكَ كَيْدًا ۖ إِنَّ الشَّيْطَانَ لِلْإِنسَانِ عَدُوٌّ مُّبِينٌ﴾
৫) জবাবে তার বাপ বললো : “হে পুত্র! তোমার এ স্বপ্ন তোমার ভাইদেরকে শুনাবে না ; শুনালে তারা তোমার ক্ষতি করার জন্য পেছনে লাগবে৷ আসলে শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু
﴿وَكَذَٰلِكَ يَجْتَبِيكَ رَبُّكَ وَيُعَلِّمُكَ مِن تَأْوِيلِ الْأَحَادِيثِ وَيُتِمُّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكَ وَعَلَىٰ آلِ يَعْقُوبَ كَمَا أَتَمَّهَا عَلَىٰ أَبَوَيْكَ مِن قَبْلُ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْحَاقَ ۚ إِنَّ رَبَّكَ عَلِيمٌ حَكِيمٌ﴾
৬) এবং ঠিক এমনটিই হবে (যেমনটি তুমি স্বপ্নে দেখেছো যে,) তোমার রব তোমাকে (তাঁর কাজের জন্য) নির্বাচিত করবেন এবং তোমাকে কথার মর্মমূলে পৌঁছানো শেখাবেন আর তোমার প্রতি ও ইয়াকূবের পরিবারের প্রতি তাঁর নিয়ামত ঠিক তেমনিভাবে পূর্ণ করবেন যেমন এর আগে তিনি তোমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম ও ইসহাকের প্রতি করেছেন৷ নিসন্দেহে তোমার রব সর্বজ্ঞ ও বিজ্ঞানময়৷”
﴿لَّقَدْ كَانَ فِي يُوسُفَ وَإِخْوَتِهِ آيَاتٌ لِّلسَّائِلِينَ﴾
৭) আসলে ইউসুফ ও তার ভাইদের ঘটনার মধ্যে এ প্রশ্নকারীদের জন্য বড় বড় নিদর্শন রয়েছে৷
﴿إِذْ قَالُوا لَيُوسُفُ وَأَخُوهُ أَحَبُّ إِلَىٰ أَبِينَا مِنَّا وَنَحْنُ عُصْبَةٌ إِنَّ أَبَانَا لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ﴾
৮) এ ঘটনা এভাবে শুরু হয় : তার ভাইয়েরা পরস্পর বলাবলি করলো, “এ ইউসুফ ও তার ভাই, এরা দু’জন আমাদের বাপের কাছে আমাদের সবার চাইতে বেশী প্রিয়, অথচ আমরা একটি পূর্ণ সংঘবদ্ধ দল৷ সত্যি বলতে কি আমাদের পিতা একেবারেই বিভ্রান্ত হয়ে গেছেন৷
﴿اقْتُلُوا يُوسُفَ أَوِ اطْرَحُوهُ أَرْضًا يَخْلُ لَكُمْ وَجْهُ أَبِيكُمْ وَتَكُونُوا مِن بَعْدِهِ قَوْمًا صَالِحِينَ﴾
৯) চলো আমরা ইউসুফকে মেরে ফেলি অথবা তাকে কোথাও ফেলে দেই, যাতে আমাদের পিতার দৃষ্টি কেবল আমাদের দিকেই ফিরে আসে৷ এ কাজটি শেষ করে তারপর তোমরা ভালো লোক হয়ে যাবে৷
﴿قَالَ قَائِلٌ مِّنْهُمْ لَا تَقْتُلُوا يُوسُفَ وَأَلْقُوهُ فِي غَيَابَتِ الْجُبِّ يَلْتَقِطْهُ بَعْضُ السَّيَّارَةِ إِن كُنتُمْ فَاعِلِينَ﴾
১০) এ কথায় তাদের একজন বললো, “ইউসুফকে মেরে ফেলো না৷ যদি কিছু করতেই হয় তাহলে তাকে কোন অন্ধ কুপে ফেলে দাও, আসা-যাওয়ার পথেকোন কাফেলা তাকে তুলে নিয়ে যাবে৷”
﴿قَالُوا يَا أَبَانَا مَا لَكَ لَا تَأْمَنَّا عَلَىٰ يُوسُفَ وَإِنَّا لَهُ لَنَاصِحُونَ﴾
১১) (এ প্রস্তাবের ভিত্তিতে) তারা তাদের বাপকে গিয়ে বললো, “আব্বাজান৷ কি ব্যাপার, আপনি ইউসুফের ব্যাপারে আমাদের ওপর ভরসা করেন না ? অথচ আমরা তার সত্যিকার শুভাকাংখী
﴿أَرْسِلْهُ مَعَنَا غَدًا يَرْتَعْ وَيَلْعَبْ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ﴾
১২) আগামীকাল তাকে আমাদের সাথে পাঠিয়ে দিন, সে কিছু ফলমূল খাবে এবং দৌড়ঝাঁপ করে মন চাংগা করবে৷ আমরা তার হেফাজত করবো৷
﴿قَالَ إِنِّي لَيَحْزُنُنِي أَن تَذْهَبُوا بِهِ وَأَخَافُ أَن يَأْكُلَهُ الذِّئْبُ وَأَنتُمْ عَنْهُ غَافِلُونَ﴾
১৩) বাপ বললো, “তোমরা তাকে নিয়ে যাবে, এটা আমাকে কষ্ট দেবে এবং আমরা আশংকা হয়, তোমরা তার প্রতি অমনোযোগী থাকবে এবং নেকড়ে থাকে খেয়ে ফেলবে৷”
﴿قَالُوا لَئِنْ أَكَلَهُ الذِّئْبُ وَنَحْنُ عُصْبَةٌ إِنَّا إِذًا لَّخَاسِرُونَ﴾
১৪) তারা জবাব দিল, “যদি আমাদের সংঘবদ্ধ দল থাকতে তাকে নেকড়ে খেয়ে ফেলে তাহলে তো আমরা হবো বড়ই অকর্মন্য৷”
﴿فَلَمَّا ذَهَبُوا بِهِ وَأَجْمَعُوا أَن يَجْعَلُوهُ فِي غَيَابَتِ الْجُبِّ ۚ وَأَوْحَيْنَا إِلَيْهِ لَتُنَبِّئَنَّهُم بِأَمْرِهِمْ هَٰذَا وَهُمْ لَا يَشْعُرُونَ﴾
১৫) এভাবে চাপ দিয়ে যখন তারা তাকে নিয়ে গেলো এবং সিদ্ধান্ত করলো তাকে একটি অন্ধ কূপে ফেলে দেবে তখন আমি ইউসুফকে অহীর মাধ্যমে জানিয়ে দিলাম, “এক সময় আসবে যখন তুমি তাদের এ কৃতকর্মের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে৷ তাদের কাজের ফলাফল সম্পর্কে তারা জানে না৷”
﴿وَجَاءُوا أَبَاهُمْ عِشَاءً يَبْكُونَ﴾
১৬) রাতে তারা কাঁদতে কাঁদতে তাদের বাপের কাছে আসলো
﴿قَالُوا يَا أَبَانَا إِنَّا ذَهَبْنَا نَسْتَبِقُ وَتَرَكْنَا يُوسُفَ عِندَ مَتَاعِنَا فَأَكَلَهُ الذِّئْبُ ۖ وَمَا أَنتَ بِمُؤْمِنٍ لَّنَا وَلَوْ كُنَّا صَادِقِينَ﴾
১৭) বললো, “আব্বাজান! আমরা দৌঁড় প্রতিযোগিতা করছিলাম এবং ইউসুফকে আমাদের জিনিসপত্রের কাছে রেখে গিয়েছিলাম, ইতিমধ্যে নেকড়েবাঘ এসে তাকে খেয়ে ফেলেছে৷ আপনি তো আমাদের কথা বিশ্বাস করবেন না, যদিও আমরা সত্যবাদী৷”
﴿وَجَاءُوا عَلَىٰ قَمِيصِهِ بِدَمٍ كَذِبٍ ۚ قَالَ بَلْ سَوَّلَتْ لَكُمْ أَنفُسُكُمْ أَمْرًا ۖ فَصَبْرٌ جَمِيلٌ ۖ وَاللَّهُ الْمُسْتَعَانُ عَلَىٰ مَا تَصِفُونَ﴾
১৮) তারা ইউসূফের জামায় মিথ্যা রক্ত লাগিয়ে নিয়ে এসেছিল৷ একথা শুনে তাদের বাপ বললো, “বরং তোমাদের মন তোমাদের জন্য একটি বড় কাজকে সহজ করে দিয়েছে৷ ঠিক আছে, আমি সবর করবো এবং খুব ভালো করেই সবর করবো৷ তোমরা যে কথা সাজাচ্ছো তার ওপর একমাত্র আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাওয়া যেতে পারে৷”
﴿وَجَاءَتْ سَيَّارَةٌ فَأَرْسَلُوا وَارِدَهُمْ فَأَدْلَىٰ دَلْوَهُ ۖ قَالَ يَا بُشْرَىٰ هَٰذَا غُلَامٌ ۚ وَأَسَرُّوهُ بِضَاعَةً ۚ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِمَا يَعْمَلُونَ﴾
১৯) ওদিকে একটি কাফেলা এলো৷ তারা তাদের পানি সংগ্রাহককে পানি নেবার জন্য পাঠালো৷ সে কূয়ার মধ্যে পানির ডোল নামিয়ে দিল৷ সে (ইউসুফকে দেখে) বলে উঠলো, “কী সুখবর! এখানে তো দেখছি একটি বালক৷” তারা তাকে পণ্য দ্রব্য হিসেবে লুকিয়ে ফেললো৷ অথচ তারা যা কিছু করছিল সে সম্পর্কে আল্লাহ অবহিত ছিলেন৷
﴿وَشَرَوْهُ بِثَمَنٍ بَخْسٍ دَرَاهِمَ مَعْدُودَةٍ وَكَانُوا فِيهِ مِنَ الزَّاهِدِينَ﴾
২০) শেষে তারা তাকে সামান্য দামে কয়েক দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করে দিল৷ আর তার দামের ব্যাপারে তারা বেশী আশা করছিল না৷
﴿وَقَالَ الَّذِي اشْتَرَاهُ مِن مِّصْرَ لِامْرَأَتِهِ أَكْرِمِي مَثْوَاهُ عَسَىٰ أَن يَنفَعَنَا أَوْ نَتَّخِذَهُ وَلَدًا ۚ وَكَذَٰلِكَ مَكَّنَّا لِيُوسُفَ فِي الْأَرْضِ وَلِنُعَلِّمَهُ مِن تَأْوِيلِ الْأَحَادِيثِ ۚ وَاللَّهُ غَالِبٌ عَلَىٰ أَمْرِهِ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ﴾
২১) মিসরে যে ব্যক্তি তাকে কিনেছিল সে তার স্ত্রীকে বললো, “একে ভালোভাবে রাখো, বিচিত্র নয় সে আমাদের জন্য উপকারী প্রমাণিত হবে এবং আমরা তাকে পুত্র বানিয়ে নেবো৷ এভাবে আমি ইউসুফের জন্য সে দেশে প্রতিষ্ঠালাভের পথ বের করে দিলাম এবং তাকে সমস্যা ও বিষয়াবলী অনুধাবন করার জন্য যথোপযোগী শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করলাম৷ আল্লাহ তাঁর কাজ সম্পন্ন করেই থাকেন, কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না৷
﴿وَلَمَّا بَلَغَ أَشُدَّهُ آتَيْنَاهُ حُكْمًا وَعِلْمًا ۚ وَكَذَٰلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ﴾
২২) আর যখন সে তার পূর্ণ যৌবনে উপনীত হলো, আমি তাকে ফায়সালা করার শক্তি ও জ্ঞান দান করলাম৷ এভাবে আমি নেক লোকদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি৷
﴿وَرَاوَدَتْهُ الَّتِي هُوَ فِي بَيْتِهَا عَن نَّفْسِهِ وَغَلَّقَتِ الْأَبْوَابَ وَقَالَتْ هَيْتَ لَكَ ۚ قَالَ مَعَاذَ اللَّهِ ۖ إِنَّهُ رَبِّي أَحْسَنَ مَثْوَايَ ۖ إِنَّهُ لَا يُفْلِحُ الظَّالِمُونَ﴾
২৩) যে মহিলাটির ঘরে সে ছিল সে তাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করতে থাকলো এবং একদিন সে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বললো, “চলে এসো”৷ ইউসুফ বললো, “আমি আল্লাহর আশ্রয় নিচ্ছি, আমার রব তো আমাকে ভালই মর্যাদা দিয়েছেন (আর আমি এ কাজ করবো!)৷ এ ধরনের জালেমরা কখনো কল্যাণ লাভ করতে পারে না৷”
﴿وَلَقَدْ هَمَّتْ بِهِ ۖ وَهَمَّ بِهَا لَوْلَا أَن رَّأَىٰ بُرْهَانَ رَبِّهِ ۚ كَذَٰلِكَ لِنَصْرِفَ عَنْهُ السُّوءَ وَالْفَحْشَاءَ ۚ إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُخْلَصِينَ﴾
২৪) মহিলাটি তার দিকে এগিয়ে এলো এবং ইউসুফও তার দিকে এগিয়ে যেতো যদি না তার রবের জ্বলন্ত প্রমাণ প্রত্যক্ষ করতো৷ এমনটিই হলো, যাতে আমি তার থেকে অসৎবৃত্তি ও অশ্লীলতা দূর করে দিতে পারি৷ আসলে সে ছিল আমার নির্বাচিত বান্দাদের অন্তরভুক্ত৷
﴿وَاسْتَبَقَا الْبَابَ وَقَدَّتْ قَمِيصَهُ مِن دُبُرٍ وَأَلْفَيَا سَيِّدَهَا لَدَى الْبَابِ ۚ قَالَتْ مَا جَزَاءُ مَنْ أَرَادَ بِأَهْلِكَ سُوءًا إِلَّا أَن يُسْجَنَ أَوْ عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾
২৫) শেষ পর্যন্ত ইউসুফ ও সে আগেপিছে দরজার দিকে দৌড়ে গেলো এবং সে পেছন থেকে ইউসুফের জামা (টেনে ধরে) ছিঁড়ে ফেললো৷ উভয়েই দরজার ওপর তার ওপর তার স্বামীকে উপস্থিত পেলো৷ তাকে দেখতেই মহিলাটি বলতে লাগলো, “তোমার পরিবারের প্রতি যে অসৎ কামনা পোষণ করে তার কি শাস্তি হতে পারে ? তাকে কারগারে প্রেরণ করা অথবা কঠোর শাস্তি দেয়া ছাড়া আর কি শাস্তি দেয়া যেতে পারে ?”
﴿قَالَ هِيَ رَاوَدَتْنِي عَن نَّفْسِي ۚ وَشَهِدَ شَاهِدٌ مِّنْ أَهْلِهَا إِن كَانَ قَمِيصُهُ قُدَّ مِن قُبُلٍ فَصَدَقَتْ وَهُوَ مِنَ الْكَاذِبِينَ﴾
২৬) ইউসুফ বললো, “ সে-ই আমাকে ফাঁসাবার চেষ্টা করছিল৷” “মহিলাটির নিজের পরিবারের একজন (পদ্ধতিগত) সাক্ষ দিল, “যদি ইউসুফের জামা সামনের দিক থেকে ছেঁড়া থাকে তাহলে মহিলাটি সত্য কথা বলেছে এবং সে মিথ্যুক
﴿وَإِن كَانَ قَمِيصُهُ قُدَّ مِن دُبُرٍ فَكَذَبَتْ وَهُوَ مِنَ الصَّادِقِينَ﴾
২৭) আর যদি তার জামা পেছনের দিক থেকে ছেঁড়া থাকে তাহলে মহিলাটি মিথ্যা কথা বলেছে এবং সে সত্যবাদী৷”
﴿فَلَمَّا رَأَىٰ قَمِيصَهُ قُدَّ مِن دُبُرٍ قَالَ إِنَّهُ مِن كَيْدِكُنَّ ۖ إِنَّ كَيْدَكُنَّ عَظِيمٌ﴾
২৮) স্বামী যখন দেখলো ইউসুফের জামা পেছনের দিক থেকে ছেঁড়া তখন বললো, “এসব তোমাদের মেয়েলোকদের ছলনা৷ সত্যিই বড়ই ভয়ানক তোমাদের ছলনা!
﴿يُوسُفُ أَعْرِضْ عَنْ هَٰذَا ۚ وَاسْتَغْفِرِي لِذَنبِكِ ۖ إِنَّكِ كُنتِ مِنَ الْخَاطِئِينَ﴾
২৯) হে ইউসুফ! এ ব্যাপারটি উপেক্ষা করো৷ আর হে নারী! তুমি নিজের অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো, তুমিই আসল অপরাধী”
﴿وَقَالَ نِسْوَةٌ فِي الْمَدِينَةِ امْرَأَتُ الْعَزِيزِ تُرَاوِدُ فَتَاهَا عَن نَّفْسِهِ ۖ قَدْ شَغَفَهَا حُبًّا ۖ إِنَّا لَنَرَاهَا فِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ﴾
৩০) শহরের মেয়েরা পরস্পর বলাবলি করতে লাগলো৷, “আযীযের স্ত্রী তার যুবক গেলামের পেছনে পড়ে আছে, প্রেম তাকে উন্মদ করে দিয়েছে৷ আমাদের মতে সে পরিষ্কার ভুল করে যাচ্ছে৷”
﴿فَلَمَّا سَمِعَتْ بِمَكْرِهِنَّ أَرْسَلَتْ إِلَيْهِنَّ وَأَعْتَدَتْ لَهُنَّ مُتَّكَأً وَآتَتْ كُلَّ وَاحِدَةٍ مِّنْهُنَّ سِكِّينًا وَقَالَتِ اخْرُجْ عَلَيْهِنَّ ۖ فَلَمَّا رَأَيْنَهُ أَكْبَرْنَهُ وَقَطَّعْنَ أَيْدِيَهُنَّ وَقُلْنَ حَاشَ لِلَّهِ مَا هَٰذَا بَشَرًا إِنْ هَٰذَا إِلَّا مَلَكٌ كَرِيمٌ﴾
৩১) সে যখন তাদের এ শঠতাপূর্ণ কথা শুনলো তখন তাদেরকে ডেকে পাঠালো৷ তাদের জন্য হেলান দিয়ে বসার মজলিসের আয়োজন করলো৷ খাওয়ার বৈঠকে তাদের সবার সামনে একটি করে ছুরি রাখলো৷ (তারপর ঠিক সেই মুহূর্তে যখন তারা ফল কেটে কেটে খাচ্ছিল) সে ইউসুফকে তাদের সামনে বের হয়ে আসার ইশারা করলো৷ যখন ঐ মেয়েদের দৃষ্টি তার ওপর পড়লো, তার বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলো এবং নিজের হাত কেটে ফেললো৷ তারা বললো, “আল্লাহর কী অপার মহিমা! এতো মানুষ নয়, এতো এক মহিমান্বিত ফেরেশ্তা৷”
﴿قَالَتْ فَذَٰلِكُنَّ الَّذِي لُمْتُنَّنِي فِيهِ ۖ وَلَقَدْ رَاوَدتُّهُ عَن نَّفْسِهِ فَاسْتَعْصَمَ ۖ وَلَئِن لَّمْ يَفْعَلْ مَا آمُرُهُ لَيُسْجَنَنَّ وَلَيَكُونًا مِّنَ الصَّاغِرِينَ﴾
৩২) আযীযের স্ত্রী বললো, “দেখলে তো! এ হলো সেই ব্যক্তি যার ব্যাপারে তোমরা আমার বিরুদ্ধে নিন্দাবাদ করতে৷ অবশ্যই আমি তাকে প্ররোচিত করার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু সে নিজেকে রক্ষা করেছে৷ যদি সে আমার কথা না মেনে নেয় তাহলে কারারুদ্ধ হবে এবং নিদারুণভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে৷”
﴿قَالَ رَبِّ السِّجْنُ أَحَبُّ إِلَيَّ مِمَّا يَدْعُونَنِي إِلَيْهِ ۖ وَإِلَّا تَصْرِفْ عَنِّي كَيْدَهُنَّ أَصْبُ إِلَيْهِنَّ وَأَكُن مِّنَ الْجَاهِلِينَ﴾
৩৩) ইউসুফ বললো, “হে আমার রব ! এরা আমাকে দিয়ে যে কাজ করাতে চাচ্ছে তার চাইতে কারাগারই আমার কাছে প্রিয়! আর যদি তুমি এদের চক্রান্ত থেকে আমাকে না বাঁচাও তাহলে আমি এদের ফাঁদে আটকে যাবো এবং অজ্ঞদের অন্তরভুক্ত হবে৷”
﴿فَاسْتَجَابَ لَهُ رَبُّهُ فَصَرَفَ عَنْهُ كَيْدَهُنَّ ۚ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ﴾
৩৪) তার রব তার দোয়া কবুল করলেন এবং তাদের অপকৌশল থেকে তাকে রক্ষা করলেন৷ অবশ্যি তিনি সবার কথা শোনেন এবং সবকিছু জানেন৷
﴿ثُمَّ بَدَا لَهُم مِّن بَعْدِ مَا رَأَوُا الْآيَاتِ لَيَسْجُنُنَّهُ حَتَّىٰ حِينٍ﴾
৩৫) তারপর তারা মনে করলো একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাকে কারারুদ্ধ করতে হবে, অথচ তারা (তার নিষ্কুলুষতা এবং নিজেদের স্ত্রীদের অসতিপনার) সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী দেখে নিয়েছিল৷
﴿وَدَخَلَ مَعَهُ السِّجْنَ فَتَيَانِ ۖ قَالَ أَحَدُهُمَا إِنِّي أَرَانِي أَعْصِرُ خَمْرًا ۖ وَقَالَ الْآخَرُ إِنِّي أَرَانِي أَحْمِلُ فَوْقَ رَأْسِي خُبْزًا تَأْكُلُ الطَّيْرُ مِنْهُ ۖ نَبِّئْنَا بِتَأْوِيلِهِ ۖ إِنَّا نَرَاكَ مِنَ الْمُحْسِنِينَ﴾
৩৬) কারাগারে তার সাথে আরো দু’টি ভৃত্যও প্রবেশ করলো৷ একদিন তাদের একজন তাকে বললো, “আমি স্বপ্নে দেখেছি আমি মদ তৈরী করছি৷” অন্যজন বললো, “আমি দেখলাম আমার মাথায় রুটি রাখা আছে এবং পাখিরা তা খাচ্ছে৷” তারা উভয়ে বললো, “আমাদের এর তা’বীর বলে দিন৷ আমরা আপনাকে সৎকর্মশীল হিসেবে পেয়েছি৷”
﴿قَالَ لَا يَأْتِيكُمَا طَعَامٌ تُرْزَقَانِهِ إِلَّا نَبَّأْتُكُمَا بِتَأْوِيلِهِ قَبْلَ أَن يَأْتِيَكُمَا ۚ ذَٰلِكُمَا مِمَّا عَلَّمَنِي رَبِّي ۚ إِنِّي تَرَكْتُ مِلَّةَ قَوْمٍ لَّا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَهُم بِالْآخِرَةِ هُمْ كَافِرُونَ﴾
৩৭) ইউসুফ বললো : “এখানে তোমরা যে খাবার পাও তা আসার আগেই আমি তোমাদের এ স্বপ্নগুলোর অর্থ বলে দেবো৷ আমার রব আমাকে যা দান করেছেন এ জ্ঞান তারই অন্তরভূক্ত৷ আসল ব্যাপার হচ্ছে, যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে না এবং আখেরাত অস্বীকার করে তাদের পথ পরিহার করে৷
﴿وَاتَّبَعْتُ مِلَّةَ آبَائِي إِبْرَاهِيمَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ ۚ مَا كَانَ لَنَا أَن نُّشْرِكَ بِاللَّهِ مِن شَيْءٍ ۚ ذَٰلِكَ مِن فَضْلِ اللَّهِ عَلَيْنَا وَعَلَى النَّاسِ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَشْكُرُونَ﴾
৩৮) আমি আমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকূবের পথ অবলম্বন করেছি৷ আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা আমাদের কাজ নয়৷ আসলে এটা আমাদের এবং সমগ্র মানব জাতির প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ (যে, তিনি আমাদের তাঁর ছাড়া আর কারোর বান্দা হিসেবে তৈরী করেননি) কিন্তু অধিকাংশ লোক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না৷
﴿يَا صَاحِبَيِ السِّجْنِ أَأَرْبَابٌ مُّتَفَرِّقُونَ خَيْرٌ أَمِ اللَّهُ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ﴾
৩৯) হে জেলখানার সাথীরা! তোমারা নিজেরাই ভেবে দেখো, ভিন্ন ভিন্ন বহু সংখ্যক রব ভালো, না এক আল্লাহ, যিনি সবার ওপর বিজয়ী৷”
﴿مَا تَعْبُدُونَ مِن دُونِهِ إِلَّا أَسْمَاءً سَمَّيْتُمُوهَا أَنتُمْ وَآبَاؤُكُم مَّا أَنزَلَ اللَّهُ بِهَا مِن سُلْطَانٍ ۚ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ۚ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ۚ ذَٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ﴾
৪০) তাঁকে বাদ দিয়ে তোমরা যাদের বন্দেগী করছো তারা শুধুমাত্র কতকগুলো নাম ছাড়া আর কিছুই নয়, যে নামগুলো তোমরা ও তোমাদের পিতৃ-পুরুষরা রেখেছো, আল্লাহ এগুলোর পক্ষে কোন প্রমাণ পাঠাননি৷ শাসন কর্তৃত্ব আল্লাহ ছাড়া আর কারোর নেই৷ তাঁর হুকুম- তোমরা তাঁর ছাড়া আর কারোর বন্দেগী করবে না৷ এটিই সরল সঠিক জীবন পদ্ধতি, কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না৷
﴿يَا صَاحِبَيِ السِّجْنِ أَمَّا أَحَدُكُمَا فَيَسْقِي رَبَّهُ خَمْرًا ۖ وَأَمَّا الْآخَرُ فَيُصْلَبُ فَتَأْكُلُ الطَّيْرُ مِن رَّأْسِهِ ۚ قُضِيَ الْأَمْرُ الَّذِي فِيهِ تَسْتَفْتِيَانِ﴾
৪১) হে জেলখানার সাথীরা! তোমাদের স্বপ্নের তা’বীর হচ্ছে, তোমাদের একজন তার নিজের প্রভুকে (মিসর রাজ) মদ পান করাবে আর দ্বিতীয় জনকে শূলবিদ্ধ করা হবে এবং পাখি তার মাথা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে৷ তোমরা যে কথা জিজ্ঞেস করছিলে তার ফায়সালা হয়ে গেছে৷
﴿وَقَالَ لِلَّذِي ظَنَّ أَنَّهُ نَاجٍ مِّنْهُمَا اذْكُرْنِي عِندَ رَبِّكَ فَأَنسَاهُ الشَّيْطَانُ ذِكْرَ رَبِّهِ فَلَبِثَ فِي السِّجْنِ بِضْعَ سِنِينَ﴾
৪২) আবার তাদের মধ্য থেকে যার সম্পর্কে ধারণা ছিল যে, সে মুক্তি পাবে ইউসুফ তাকে বললো : “তোমার প্রভুকে (মিসরের বাদশাহ) আমার কথা বলো৷” কিন্তু শয়তান তাকে এমন গাফেল করে দিল যে, সে তার প্রভুকে (মিসরের বাদাশাহ) তার কথা বলতে ভুলে গেলো৷ ফলে ইউসুফ কয়েক বছর কারাগারে পড়ে রইলো৷
﴿وَقَالَ الْمَلِكُ إِنِّي أَرَىٰ سَبْعَ بَقَرَاتٍ سِمَانٍ يَأْكُلُهُنَّ سَبْعٌ عِجَافٌ وَسَبْعَ سُنبُلَاتٍ خُضْرٍ وَأُخَرَ يَابِسَاتٍ ۖ يَا أَيُّهَا الْمَلَأُ أَفْتُونِي فِي رُؤْيَايَ إِن كُنتُمْ لِلرُّؤْيَا تَعْبُرُونَ﴾
৪৩) একদিন বাদশাহ বললো, “আমি স্বপ্ন দেখেছি, সাতটি মোটা গাভীকে সাতটি পাতলা গাভী খেয়ে ফেলছে এবং সাতটি সবুজ শীষ ও সাতটি শুকনো শীষ৷ হে সভাসদবৃন্দ! আমাকে এ স্বপ্নের তা’বীর বলে দাও, যদি তোমরা স্বপ্নের মানে বুঝে থাকো৷”
﴿قَالُوا أَضْغَاثُ أَحْلَامٍ ۖ وَمَا نَحْنُ بِتَأْوِيلِ الْأَحْلَامِ بِعَالِمِينَ﴾
৪৪) লোকেরা বললা, “এসব তো অর্থহীন স্বপ্ন, আর আমরা এ ধরনের স্বপ্নের মানে জানি না৷”
﴿وَقَالَ الَّذِي نَجَا مِنْهُمَا وَادَّكَرَ بَعْدَ أُمَّةٍ أَنَا أُنَبِّئُكُم بِتَأْوِيلِهِ فَأَرْسِلُونِ﴾
৪৫) সেই দু’জন কয়েদীর মধ্য থেকে যে বেঁচে গিয়েছিল এবং দীর্ঘকাল পরে এখন যার মনে পড়েছিল, সে বললো, “আমি আপনাদের এর তা’বীর বলে দিচ্ছি, আমাকে একটু (কারাগারে ইউসুফের কাছে) পাঠিয়ে দিন৷”
﴿يُوسُفُ أَيُّهَا الصِّدِّيقُ أَفْتِنَا فِي سَبْعِ بَقَرَاتٍ سِمَانٍ يَأْكُلُهُنَّ سَبْعٌ عِجَافٌ وَسَبْعِ سُنبُلَاتٍ خُضْرٍ وَأُخَرَ يَابِسَاتٍ لَّعَلِّي أَرْجِعُ إِلَى النَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَعْلَمُونَ﴾
৪৬) সে গিয়ে বললো, “হে সত্যবাদিতার প্রতীক ইউসুফ! আমাকে এ স্বপ্নের অর্থ বলে দাও : সাতটি মোটা গাভীকে সাতটি পাতলা গাভী খেয়ে ফেলছে এবং সাতটি শীষ সবুজ ও সাতটি শীর্ষ শুকনো সম্ভবত আমি লোকদের কাছে ফিরে যেতে পারবো এবং তারা জানতে পারবে৷
﴿قَالَ تَزْرَعُونَ سَبْعَ سِنِينَ دَأَبًا فَمَا حَصَدتُّمْ فَذَرُوهُ فِي سُنبُلِهِ إِلَّا قَلِيلًا مِّمَّا تَأْكُلُونَ﴾
৪৭) ইউসুফ বললো, “তোমরা সাত বছর পর্যন্ত লাগাতার চাষাবাদ করতে থাকবে৷ এ সময় তোমরা যে ফসল কাটবে তা থেকে সামান্য পরিমাণ তোমাদের আহারের প্রয়োজনে বের করে নেবে এবং বাদবাকি সব শীষ সমেত রেখে দেবে৷
﴿ثُمَّ يَأْتِي مِن بَعْدِ ذَٰلِكَ سَبْعٌ شِدَادٌ يَأْكُلْنَ مَا قَدَّمْتُمْ لَهُنَّ إِلَّا قَلِيلًا مِّمَّا تُحْصِنُونَ﴾
৪৮) তারপর সাতটি বছর আসছে বড়ই কঠিন৷ এ সময়ের জন্য তোমরা যে শস্য জমা করবে তা সমস্ত এ সময়ে খেয়ে ফেলা হবে৷ যদি কিছু বেঁচে যায় তাহলে তা হবে কেবলমাত্র সেটুকুই যা তোমরা সংরক্ষণ করবে৷
﴿ثُمَّ يَأْتِي مِن بَعْدِ ذَٰلِكَ عَامٌ فِيهِ يُغَاثُ النَّاسُ وَفِيهِ يَعْصِرُونَ﴾
৪৯) এরপর আবার এক বছর এমন আসবে যখন রহমতের বৃষ্টি ধারার মাধ্যমে মানুষের আবেদন পূর্ণ করা হবে এবং তারা রস নিংড়াবে৷”
﴿وَقَالَ الْمَلِكُ ائْتُونِي بِهِ ۖ فَلَمَّا جَاءَهُ الرَّسُولُ قَالَ ارْجِعْ إِلَىٰ رَبِّكَ فَاسْأَلْهُ مَا بَالُ النِّسْوَةِ اللَّاتِي قَطَّعْنَ أَيْدِيَهُنَّ ۚ إِنَّ رَبِّي بِكَيْدِهِنَّ عَلِيمٌ﴾
৫০) বাদশাহ বললো, “তাকে আমার কাছে আনো৷” কিন্তু বাদশাহর দূত যখন ইউসুফের কাছে পৌঁছুলে তখন সে বললো, তোমার প্রভুর কাছে ফিরে যাও এবং তাকে জিজ্ঞেস করো, যে মহিলারা হাত কেটে ফেলেছিল তাদের ব্যাপারটা কি ? আমার রব তো তাদের চক্রান্ত সম্পর্কে অবগত৷”
﴿قَالَ مَا خَطْبُكُنَّ إِذْ رَاوَدتُّنَّ يُوسُفَ عَن نَّفْسِهِ ۚ قُلْنَ حَاشَ لِلَّهِ مَا عَلِمْنَا عَلَيْهِ مِن سُوءٍ ۚ قَالَتِ امْرَأَتُ الْعَزِيزِ الْآنَ حَصْحَصَ الْحَقُّ أَنَا رَاوَدتُّهُ عَن نَّفْسِهِ وَإِنَّهُ لَمِنَ الصَّادِقِينَ﴾
৫১) একথায় বাদশাহ সেই মহিলাদেরকে জিজ্ঞেস করলো, “তোমরা যখন ইউসুফকে অসৎকাজে প্ররোচিত করার চেষ্টা করেছিলে তোমাদের তখনকার অভিজ্ঞতা কি ?” সবাই একবাক্যে বললো, “আল্লাহর কী অপার মহিমা! আমরা তার মধ্যে অসৎ প্রবণতার গন্ধই পাইনি৷” আযীযের স্ত্রী বলে উঠলো, “এখন সত্য প্রকাশ হয়ে গেছে৷ আমিই তাকে ফুসলাবার চেষ্টা করেছিলাম, নিসন্দেহে সে একদম সত্যবাদী৷”
﴿ذَٰلِكَ لِيَعْلَمَ أَنِّي لَمْ أَخُنْهُ بِالْغَيْبِ وَأَنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي كَيْدَ الْخَائِنِينَ﴾
৫২) (ইউসুফ বললো 🙂 “ এ থেকে আমার উদ্দেশ্যে এই ছিল যে, আযীয জানতে পারুক, আমি তার অবর্তমানে তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিনি এবং আল্লাহ বিশ্বাস ঘাতকতারকারীদের চক্রান্ত সফল করেন না৷
﴿وَمَا أُبَرِّئُ نَفْسِي ۚ إِنَّ النَّفْسَ لَأَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ إِلَّا مَا رَحِمَ رَبِّي ۚ إِنَّ رَبِّي غَفُورٌ رَّحِيمٌ﴾
৫৩) আমি নিজের নফ্সকে দোষমুক্ত করছি না৷ নফ্স তো খারাপ কাজ করতে প্ররোচিত করে, তবে যদি কারোর প্রতি আমার রবের অনুগ্রহ হয় সে ছাড়া৷ অবশ্যি আমার রব বড়ই ক্ষমাশীল ও মেহেরবান৷”
﴿وَقَالَ الْمَلِكُ ائْتُونِي بِهِ أَسْتَخْلِصْهُ لِنَفْسِي ۖ فَلَمَّا كَلَّمَهُ قَالَ إِنَّكَ الْيَوْمَ لَدَيْنَا مَكِينٌ أَمِينٌ﴾
৫৪) বাদশাহ বললো, “ তাকে আমার কাছে আনো, আমি তাকে একান্তভাবে নিজের জন্য নির্দিষ্ট করে নেব৷”ইউসুফ যখন তার সাথে আলাপ করলো, সে বললো, “এখন আপনি আমাদের এখানে সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী এবং আপনার আমানতদারীর ওপর পূর্ণ ভরসা আছে৷”
﴿قَالَ اجْعَلْنِي عَلَىٰ خَزَائِنِ الْأَرْضِ ۖ إِنِّي حَفِيظٌ عَلِيمٌ﴾
৫৫) ইউসুফ বললো, “দেশের অর্থ-সম্পদ আমার হাতে সোপর্দ করুন৷ আমি সংরক্ষণকারী এবং জ্ঞানও রাখি৷”
﴿وَكَذَٰلِكَ مَكَّنَّا لِيُوسُفَ فِي الْأَرْضِ يَتَبَوَّأُ مِنْهَا حَيْثُ يَشَاءُ ۚ نُصِيبُ بِرَحْمَتِنَا مَن نَّشَاءُ ۖ وَلَا نُضِيعُ أَجْرَ الْمُحْسِنِينَ﴾
৫৬) এভাবে আমি পৃথিবীতে ইউসুফের জন্য কতৃত্বের পথ পরিষ্কার করেছি৷ সেখানে সে যেখানে ইচ্ছা অবস্থান করতে পারতো৷ আমি যাকে ইচ্ছা নিজের রহমতে অভিষিক্ত করি৷ সৎকর্মশীল লোকদের প্রতিদান আমি নষ্ট করি না৷
﴿وَلَأَجْرُ الْآخِرَةِ خَيْرٌ لِّلَّذِينَ آمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ﴾
৫৭) আর যারা ঈমান এনেছে এবং তাওয়া সহকারে কাজ করতে থেকেছে আখেরাতের প্রতিদান তাদের জন্য আরো ভালো৷”
﴿وَجَاءَ إِخْوَةُ يُوسُفَ فَدَخَلُوا عَلَيْهِ فَعَرَفَهُمْ وَهُمْ لَهُ مُنكِرُونَ﴾
৫৮) ইউসুফের ভাইরো মিসরে এলো এবং তার কাছে হাযির হলো৷ সে তাদেরকে চিনে ফেললো৷ কিন্তু তারা তাকে চিনতে পারলো না৷
﴿وَلَمَّا جَهَّزَهُم بِجَهَازِهِمْ قَالَ ائْتُونِي بِأَخٍ لَّكُم مِّنْ أَبِيكُمْ ۚ أَلَا تَرَوْنَ أَنِّي أُوفِي الْكَيْلَ وَأَنَا خَيْرُ الْمُنزِلِينَ﴾
৫৯) তারপর সে যখন তাদের জিনিসপত্র তৈরী করালো তখন চলার সময় তাদেরকে বললো, “তোমাদের বৈমাত্রেয় ভাইয়ে আমাদের কাছে আনবে, দেখছো না আমি কেমন পরিমাপ পাত্র ভরে দেই এবং আমি কেমন ভালো অতিথিপরায়ণ ?
﴿فَإِن لَّمْ تَأْتُونِي بِهِ فَلَا كَيْلَ لَكُمْ عِندِي وَلَا تَقْرَبُونِ﴾
৬০) যদি তোমরা তাকে না আনো তাহলে আমার কাছে তোমাদের জন্য কোন শস্য নেই বরং তোমরা আমার ধারেকাছেও এসো না৷”
﴿قَالُوا سَنُرَاوِدُ عَنْهُ أَبَاهُ وَإِنَّا لَفَاعِلُونَ﴾
৬১) তারা বললো, “আমরা চেষ্টা করবো যাতে আব্বাজান তাকে পাঠাতে রাযী হয়ে যান এবং আমরা নিশ্চয়ই এমনটি করবো৷”
﴿وَقَالَ لِفِتْيَانِهِ اجْعَلُوا بِضَاعَتَهُمْ فِي رِحَالِهِمْ لَعَلَّهُمْ يَعْرِفُونَهَا إِذَا انقَلَبُوا إِلَىٰ أَهْلِهِمْ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ﴾
৬২) ইউসুফ নিজের গোলামদেরকে ইশারা করে বললো, “ওরা শস্যের বিনিময়ে যে অর্থ দিয়েছে তা চুপিসারে ওদের জিনিসপত্রের মধ্যেই রেখে দাও৷” ইউসুফ এটা করলো এ আশায় যে, বাড়িতে পৌঁছে তারা নিজেদের ফেরত পাওয়া অর্থ চিনতে পারবে (অথবা এ দানশীলতার ফলে তারা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হবে) এবং বিচিত্র নয় যে, তারা আবার ফিরে আসবে৷
﴿فَلَمَّا رَجَعُوا إِلَىٰ أَبِيهِمْ قَالُوا يَا أَبَانَا مُنِعَ مِنَّا الْكَيْلُ فَأَرْسِلْ مَعَنَا أَخَانَا نَكْتَلْ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ﴾
৬৩) যখন তারা তাদের বাপের কাছে ফিরে গেলো তখন বললো, “আব্বাজান! আগামীতে আমাদের শস্য দিতে অস্বীকার করা হয়েছে, কাজেই আমাদের ভাইকে আমাদের সাথে পাঠিয়ে দিন, যাতে আমরা শস্য নিয়ে আসতে পারি এবং অবশ্যি আমরা হেফাজতের জন্য দায়ী থাকবো৷”
﴿قَالَ هَلْ آمَنُكُمْ عَلَيْهِ إِلَّا كَمَا أَمِنتُكُمْ عَلَىٰ أَخِيهِ مِن قَبْلُ ۖ فَاللَّهُ خَيْرٌ حَافِظًا ۖ وَهُوَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ﴾
৬৪) বাপ জবাব দিল, “আমি কি ওর ব্যাপারে তোমাদের ওপর ঠিক তেমনি ভরসা করবো যে, ইতিপূর্বে তার ভাইয়ের ব্যাপারে করেছিলাম ? অবশ্য আল্লাহ সবচেয়ে ভালো হেফাজতকারী এবং তিনি সবচেয়ে বেশী করুণাশীল৷”
﴿وَلَمَّا فَتَحُوا مَتَاعَهُمْ وَجَدُوا بِضَاعَتَهُمْ رُدَّتْ إِلَيْهِمْ ۖ قَالُوا يَا أَبَانَا مَا نَبْغِي ۖ هَٰذِهِ بِضَاعَتُنَا رُدَّتْ إِلَيْنَا ۖ وَنَمِيرُ أَهْلَنَا وَنَحْفَظُ أَخَانَا وَنَزْدَادُ كَيْلَ بَعِيرٍ ۖ ذَٰلِكَ كَيْلٌ يَسِيرٌ﴾
৬৫) তারপর যখন তারা নিজেদের জিনিসপত্র খুললো, তারা দেখলো তাদের অর্থও তাদেরকে ফেরত দেয়া হয়েছে৷ এ দৃশ্য দেখে তারা চিৎকার করে উঠলো, “আব্বাজান, আমাদের আর কী চাই ! দেখুন এই আমাদের অর্থও আমাদের ফেরত দেয়া হয়েছে৷ ব্যস্ এবার আমরা যাবো আর নিজেদের পরিজনদের জন্য রসদ নিয়ে আসবো, নিজেদের ভাইয়ের হেফাজতও করবো এবং অতিরিক্ত একটি উট বোঝাই করে শস্যও আনবো, এ পরিমাণ শস্য বৃদ্ধি অতি সহজেই হয়ে যাবে৷”
﴿قَالَ لَنْ أُرْسِلَهُ مَعَكُمْ حَتَّىٰ تُؤْتُونِ مَوْثِقًا مِّنَ اللَّهِ لَتَأْتُنَّنِي بِهِ إِلَّا أَن يُحَاطَ بِكُمْ ۖ فَلَمَّا آتَوْهُ مَوْثِقَهُمْ قَالَ اللَّهُ عَلَىٰ مَا نَقُولُ وَكِيلٌ﴾
৬৬) তাদের বাপ বললো, “আমি কখনোই তাকে তোমাদের সাথে পাঠাবো না যতক্ষণ না তোমরা আল্লাহর নামে আমার কাছে অংগীকার করবে৷ এ মর্মে যে তাকে নিশ্চয়ই আমার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে তবে হাঁ যদি কোথাও তোমরা ঘেরাও হয়ে যাও তাহলে ভিন্ন কথা৷” যখন তারা তার কাছে অংগীকার করলো তখন সে বললো, “দেখো আল্লাহ আমাদের একথার রক্ষক৷”
﴿وَقَالَ يَا بَنِيَّ لَا تَدْخُلُوا مِن بَابٍ وَاحِدٍ وَادْخُلُوا مِنْ أَبْوَابٍ مُّتَفَرِّقَةٍ ۖ وَمَا أُغْنِي عَنكُم مِّنَ اللَّهِ مِن شَيْءٍ ۖ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ۖ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ ۖ وَعَلَيْهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُتَوَكِّلُونَ﴾
৬৭) তারপর সে বললো, “হে আমার সন্তানরা! মিসরের রাজধানীতে এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করো না বরং বিভিন্ন দরজা দিয়ে প্রবেশ করো৷ কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা থেকে আমি তোমাদের বাঁচাতে পারি না৷ তাঁর ছাড়া আর কারোর হুকুম চলে না, তাঁর ওপরই আমি ভরসা করি এবং যার ভরসা করতে হয় তাঁর ওপরই করতে হবে৷”
﴿وَلَمَّا دَخَلُوا مِنْ حَيْثُ أَمَرَهُمْ أَبُوهُم مَّا كَانَ يُغْنِي عَنْهُم مِّنَ اللَّهِ مِن شَيْءٍ إِلَّا حَاجَةً فِي نَفْسِ يَعْقُوبَ قَضَاهَا ۚ وَإِنَّهُ لَذُو عِلْمٍ لِّمَا عَلَّمْنَاهُ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ﴾
৬৮) আর ঘটনাক্ষেত্রে তা-ই হলো, যখন তারা নিজেদের বাপের নির্দেশ মতো শহরে (বিভিন্ন দরজা দিয়ে) প্রবেশ করল তখন তার এ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা আল্লাহর ইচ্ছার মোকাবিলায় কোন কাজে লাগলো না৷ তবে হাঁ, ইয়াকূবের মনে যে একটি খটকা ছিল তা দূর করার জন্য সে নিজের মনমতো চেষ্টা করে নিল৷ অবশ্যি সে আমার দেয়া শিক্ষায় জ্ঞানবান ছিল কিন্তু অধিকাংশ লোক প্রকৃত সত্য জানে না৷
﴿وَلَمَّا دَخَلُوا عَلَىٰ يُوسُفَ آوَىٰ إِلَيْهِ أَخَاهُ ۖ قَالَ إِنِّي أَنَا أَخُوكَ فَلَا تَبْتَئِسْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾
৬৯) তারা ইউসুফের কাছে পৌঁছলে সে সহোদর ভাইকে নিজের কাছে আলাদা করে ডেকে নিল এবং তাকে বললো, “আমি তোমার সেই (হারানো) ভাই, এখন আর সেসব আচরণের জন্য দুঃখ করো না যা এরা করে এসেছে”
﴿فَلَمَّا جَهَّزَهُم بِجَهَازِهِمْ جَعَلَ السِّقَايَةَ فِي رَحْلِ أَخِيهِ ثُمَّ أَذَّنَ مُؤَذِّنٌ أَيَّتُهَا الْعِيرُ إِنَّكُمْ لَسَارِقُونَ﴾
৭০) যখন ইউসুফ তাদের মালপত্র বোঝাই করাতে লাগলো তখন নিজের ভাইয়ের মালপত্রের মধ্যে নিজের পেয়ালা রেখে দিল৷ তারপর একজন নকীব চীৎকার করে বললো, “হে যাত্রীদল! তোমরা চোর৷”
﴿قَالُوا وَأَقْبَلُوا عَلَيْهِم مَّاذَا تَفْقِدُونَ﴾
৭১) তারা পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করলো, “ তোমাদের কি হারিয়ে গেছে ?”
﴿قَالُوا نَفْقِدُ صُوَاعَ الْمَلِكِ وَلِمَن جَاءَ بِهِ حِمْلُ بَعِيرٍ وَأَنَا بِهِ زَعِيمٌ﴾
৭২) সরকারী কর্মচারী বললো, “আমরা বাদশাহার পানপাত্র পাচ্ছি না,” (এবং তাদের জমাদার বললো 🙂 “যে ব্যক্তি তা এনে দেবে তার জন্য রয়েছে পুরস্কার এক উট বোঝাই মাল৷ আমি এর দায়িত্ব নিচ্ছি৷”
﴿قَالُوا تَاللَّهِ لَقَدْ عَلِمْتُم مَّا جِئْنَا لِنُفْسِدَ فِي الْأَرْضِ وَمَا كُنَّا سَارِقِينَ﴾
৭৩) এ ভাইয়েরা বললো, “আল্লাহর কসম! তোমরা খুব ভালোভাবেই জানো, আমরা এ দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে আসিনি এবং চুরি করার মতো লোক আমরা নই”
﴿قَالُوا فَمَا جَزَاؤُهُ إِن كُنتُمْ كَاذِبِينَ﴾
৭৪) তারা বললো, “আচ্ছা, যদি তোমাদের কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয় তাহলে চোরের কি শাস্তি হবে ?”
﴿قَالُوا جَزَاؤُهُ مَن وُجِدَ فِي رَحْلِهِ فَهُوَ جَزَاؤُهُ ۚ كَذَٰلِكَ نَجْزِي الظَّالِمِينَ﴾
৭৫) তারা জবাব দিল, “তার শাস্তি” যার মালপত্রের মধ্যে ঐ জিনিস পাওয়া যাবে তার শাস্তি হিসেবে তাকেই রেখে দেয়া হবে৷ আমাদের এখানে তো এটাই এ ধরনের জালেমদের শাস্তির পদ্ধতি৷”
﴿فَبَدَأَ بِأَوْعِيَتِهِمْ قَبْلَ وِعَاءِ أَخِيهِ ثُمَّ اسْتَخْرَجَهَا مِن وِعَاءِ أَخِيهِ ۚ كَذَٰلِكَ كِدْنَا لِيُوسُفَ ۖ مَا كَانَ لِيَأْخُذَ أَخَاهُ فِي دِينِ الْمَلِكِ إِلَّا أَن يَشَاءَ اللَّهُ ۚ نَرْفَعُ دَرَجَاتٍ مَّن نَّشَاءُ ۗ وَفَوْقَ كُلِّ ذِي عِلْمٍ عَلِيمٌ﴾
৭৬) তখন ইউসুফ নিজের ভাইয়ের আগে তাদের থলের তল্লাশী শুরু করে দিল৷ তারপর নিজের ভাইয়ের থলের মধ্য থেকে হারানো জিনিস বের করে ফেললো৷ – এভাবে আমি নিজের কৌশলের মাধ্যমে ইউসুফকে সহায়তা করলাম৷ বাদশাহর দীন (অর্থাৎ মিসরের বাদশাহর আইন) অনুযায়ী নিজের ভাইক পাকড়াও করা তার পক্ষে সংগত ছিল না, তবে যদি আল্লাহই এমনটি চান৷ যাকে চাই তার মর্তবা আমি বুলন্দ করে দেই আর একজন জ্ঞানবান এমন আছে যে প্রত্যেক জ্ঞানবানের চেয়ে জ্ঞানী৷
﴿قَالُوا إِن يَسْرِقْ فَقَدْ سَرَقَ أَخٌ لَّهُ مِن قَبْلُ ۚ فَأَسَرَّهَا يُوسُفُ فِي نَفْسِهِ وَلَمْ يُبْدِهَا لَهُمْ ۚ قَالَ أَنتُمْ شَرٌّ مَّكَانًا ۖ وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا تَصِفُونَ﴾
৭৭) এ ভাইয়েরা বললো, “এ যদি চুরি করে থাকে তাহলে অবাক হবার কিছু নেই, কারণ এর আগে এর ভাইও (ইউসুফ) চুরি করেছিল৷” ইউসুফ তাদের একথা শুনে আতস্থ করে ফেললো, সত্য তাদের কাছে প্রকাশ করলো না শুধুমাত্র (মনে মনে) এতটুকু বলে থেমে গেলো, “বড়ই বদ তোমরা (আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার ওপর এই যে দোষারোপ তোমরা করছো সে সম্পর্কে আল্লাহ প্রকৃত সত্য ভালোভাবে অবগত৷”
﴿قَالُوا يَا أَيُّهَا الْعَزِيزُ إِنَّ لَهُ أَبًا شَيْخًا كَبِيرًا فَخُذْ أَحَدَنَا مَكَانَهُ ۖ إِنَّا نَرَاكَ مِنَ الْمُحْسِنِينَ﴾
৭৮) তারা বললো, “হে ক্ষমাতাসীন সরদার (আযীয)! এর বাপ অত্যন্ত বৃদ্ধ, এর জায়গায় আপনি আমাদের কাউকে রেখে দিন৷ আমরা আপনাকে বড়ই সদাচারী ব্যক্তি হিসেবে পেয়েছি৷”
﴿قَالَ مَعَاذَ اللَّهِ أَن نَّأْخُذَ إِلَّا مَن وَجَدْنَا مَتَاعَنَا عِندَهُ إِنَّا إِذًا لَّظَالِمُونَ﴾
৭৯) ইউসুফ বললেন, “আল্লাহর পানাহ! অন্য কাউকে আমরা কেমন করে রাখতে পারি ? যার কাছে আমরা নিজেদের জিনিস পেয়েছি তাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য কাউকে রাখলে আমরা জালেম হয়ে যাবো৷”
﴿فَلَمَّا اسْتَيْأَسُوا مِنْهُ خَلَصُوا نَجِيًّا ۖ قَالَ كَبِيرُهُمْ أَلَمْ تَعْلَمُوا أَنَّ أَبَاكُمْ قَدْ أَخَذَ عَلَيْكُم مَّوْثِقًا مِّنَ اللَّهِ وَمِن قَبْلُ مَا فَرَّطتُمْ فِي يُوسُفَ ۖ فَلَنْ أَبْرَحَ الْأَرْضَ حَتَّىٰ يَأْذَنَ لِي أَبِي أَوْ يَحْكُمَ اللَّهُ لِي ۖ وَهُوَ خَيْرُ الْحَاكِمِينَ﴾
৮০) যখন তারা ইউসুফের কাছ থেকে নিরাশ হয়ে গেলো তখন একান্তে পরামর্শ করতে লাগলো৷ তাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বয়সে বড় ছিল সে বললো : “তোমরা কি জান না, তোমাদের বাপ তোমাদের কাছ থেকে আল্লাহর নামে কি অংগীকার নিয়েছেন এবং ইতিপূর্বে ইউসুফের ব্যাপারে তোমরা যেসব বাড়াবাড়ি করেছো তাও তোমরা জানো৷ এখন আমি তো এখান থেকে কখনোই যাবো না যে পর্যন্ত না আমার বাপ আমাকে অনুমতি দেন অথবা আল্লাহ আমার ব্যাপারে কোন ফায়সালা করে দেন, কেননা তিনি সবচেয়ে ভালো ফায়সালাকারী৷
﴿ارْجِعُوا إِلَىٰ أَبِيكُمْ فَقُولُوا يَا أَبَانَا إِنَّ ابْنَكَ سَرَقَ وَمَا شَهِدْنَا إِلَّا بِمَا عَلِمْنَا وَمَا كُنَّا لِلْغَيْبِ حَافِظِينَ﴾
৮১) তোমরা তোমাদের বাপের কাছে ফিরে গিয়ে বলো, “আব্বাজান, আপনার ছেলে চুরি করেছে, আমরা তাকে চুরি করতে দেখিনি, যতটুকু আমরা জেনেছি শুধু ততটুকুই বর্ণনা করছি এবং অদৃশ্যেরই রক্ষণাবেক্ষণ করা তো আমাদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না৷
﴿وَاسْأَلِ الْقَرْيَةَ الَّتِي كُنَّا فِيهَا وَالْعِيرَ الَّتِي أَقْبَلْنَا فِيهَا ۖ وَإِنَّا لَصَادِقُونَ﴾
৮২) আমরা যে পল্লীতে ছিলাম সেখানকার লোকজনদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখুন এবং যে কাফেলার সাথে আমরা ছিলাম তাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, আমরা যা বলছি৷”
﴿قَالَ بَلْ سَوَّلَتْ لَكُمْ أَنفُسُكُمْ أَمْرًا ۖ فَصَبْرٌ جَمِيلٌ ۖ عَسَى اللَّهُ أَن يَأْتِيَنِي بِهِمْ جَمِيعًا ۚ إِنَّهُ هُوَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ﴾
৮৩) ইয়াকূব এ কাহিনী শুনে বললো, “আসলে তোমাদের মন তোমাদের জন্য আরো একটি বড় ঘটনাকে সহজ করে দিয়েছে৷ ঠিক আছে, এ ব্যাপারেও আমি সবর করবো এবং ভালো করেই করবো৷ হয়তো আল্লাহ এদের সবাইকে এনে আমার সাথে মিলিয়ে দেবেন৷ তিনি সবকিছু জানেন এবং তিনি জ্ঞানের ভিত্তিতে সমস্ত কাজ করেন৷”
﴿وَتَوَلَّىٰ عَنْهُمْ وَقَالَ يَا أَسَفَىٰ عَلَىٰ يُوسُفَ وَابْيَضَّتْ عَيْنَاهُ مِنَ الْحُزْنِ فَهُوَ كَظِيمٌ﴾
৮৪) তারপর সে তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বসে গেলো এবং বলতে লাগলো, “হায় ইউসুফ”- সে মনে মনে দুঃখে ও শোকে জর্জরিত হয়ে যাচ্ছিল এবং তার চোখগুলো সাদা হয়ে গিয়েছিল,
﴿قَالُوا تَاللَّهِ تَفْتَأُ تَذْكُرُ يُوسُفَ حَتَّىٰ تَكُونَ حَرَضًا أَوْ تَكُونَ مِنَ الْهَالِكِينَ﴾
৮৫) ছেলেরা বললো, “আল্লাহর দোহাই! আপনি তো শুধু ইউসুফের কথাই স্মরণ করে যাচ্ছেন৷ অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, তার শোকে আপনি নিজেকে দিশেহারা করে ফেলবেন অথবা নিজের প্রাণ সংহার করবেন৷”
﴿قَالَ إِنَّمَا أَشْكُو بَثِّي وَحُزْنِي إِلَى اللَّهِ وَأَعْلَمُ مِنَ اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ﴾
৮৬) সে বললো, “আমি আমার পেরেশানি এবং আমার দুঃখের ফরিয়াদ আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে করছি না৷ আর আল্লাহর ব্যাপারে আমি যতটুকু জানি তোমরা ততটুকু জানো না৷
﴿يَا بَنِيَّ اذْهَبُوا فَتَحَسَّسُوا مِن يُوسُفَ وَأَخِيهِ وَلَا تَيْأَسُوا مِن رَّوْحِ اللَّهِ ۖ إِنَّهُ لَا يَيْأَسُ مِن رَّوْحِ اللَّهِ إِلَّا الْقَوْمُ الْكَافِرُونَ﴾
৮৭) হে আমার ছেলেরা! তোমরা যাও এবং ইউসুফ ও তার ভাইয়ের ব্যাপারে কিছু অনুসন্ধান চালাও৷ আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না৷ তাঁর রহমত থেকে তো একমাত্র কাফেররাই নিরাশ হয়৷”
﴿فَلَمَّا دَخَلُوا عَلَيْهِ قَالُوا يَا أَيُّهَا الْعَزِيزُ مَسَّنَا وَأَهْلَنَا الضُّرُّ وَجِئْنَا بِبِضَاعَةٍ مُّزْجَاةٍ فَأَوْفِ لَنَا الْكَيْلَ وَتَصَدَّقْ عَلَيْنَا ۖ إِنَّ اللَّهَ يَجْزِي الْمُتَصَدِّقِينَ﴾
৮৮) যখন তারা মিসরে গিয়ে ইউসুফের সামনে হাযির হলো তখন আরয করলো, “হে পরাক্রান্ত শাসক! আমরা ও আমাদের পরিবার পরিজন কঠিন বিপদের মুখোমুখি হয়েছি এবং আমরা মাত্র সামান্য পুঁজি নিয়ে এসেছি৷ আপনি আমাদের পূর্ণমাত্রায় শস্য দিয়ে দিন এবং আমাদেরকে দান করুন, আল্লাহ দানকারীদেরকে প্রতিদান দেন৷”
﴿قَالَ هَلْ عَلِمْتُم مَّا فَعَلْتُم بِيُوسُفَ وَأَخِيهِ إِذْ أَنتُمْ جَاهِلُونَ﴾
৮৯) (একথা শুনে ইউসুফ আর চুপ থাকতে পারলো না) সে বললো, “তোমরা কি জানো, তোমরা ইউসুফ ও তার ভাইয়ের সাথে কি ব্যবহার করেছিলে, যখন তোমরা অজ্ঞ ছিলে ?”
﴿قَالُوا أَإِنَّكَ لَأَنتَ يُوسُفُ ۖ قَالَ أَنَا يُوسُفُ وَهَٰذَا أَخِي ۖ قَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَيْنَا ۖ إِنَّهُ مَن يَتَّقِ وَيَصْبِرْ فَإِنَّ اللَّهَ لَا يُضِيعُ أَجْرَ الْمُحْسِنِينَ﴾
৯০) তারা চমকে উঠে বললো, “হায় তুমিই ইউসুফ নাকি ?” সে বললো, “হাঁ, আমি ইউসুফ এবং এই আমার সহোদর৷ আল্লাহ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন৷ আসলে সেউ যদি তাকওয়া ও ছবর অবলম্বন করে তাহলে আল্লাহর কাছে এ ধরণের সৎলোকদের কর্মফল নষ্ট হয়ে যায় না৷”
﴿قَالُوا تَاللَّهِ لَقَدْ آثَرَكَ اللَّهُ عَلَيْنَا وَإِن كُنَّا لَخَاطِئِينَ﴾
৯১) তারা বললো, “আল্লাহর কসম, আল্লাহ তোমাকে আমাদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং যথার্থই আমরা অপরাধী ছিলাম৷”
﴿قَالَ لَا تَثْرِيبَ عَلَيْكُمُ الْيَوْمَ ۖ يَغْفِرُ اللَّهُ لَكُمْ ۖ وَهُوَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ﴾
৯২) সে জবাব দিল, “আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই৷ আল্লাহ তোমাদের মাফ করে দিন৷ তিনি সবার প্রতি অনুগ্রহকারী৷
﴿اذْهَبُوا بِقَمِيصِي هَٰذَا فَأَلْقُوهُ عَلَىٰ وَجْهِ أَبِي يَأْتِ بَصِيرًا وَأْتُونِي بِأَهْلِكُمْ أَجْمَعِينَ﴾
৯৩) যাও, আমার এ জামাটি নিয়ে যাও এবং এটি আমার পিতার চেহারার ওপর রেখো, তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন৷ আর তোমাদের সমস্ত পরিবার পরিজনকে আমার কাছে নিয়ে এসো৷”
﴿وَلَمَّا فَصَلَتِ الْعِيرُ قَالَ أَبُوهُمْ إِنِّي لَأَجِدُ رِيحَ يُوسُفَ ۖ لَوْلَا أَن تُفَنِّدُونِ﴾
৯৪) কাফেলাটি যখন (মিসর থেকে) রওয়ানা দিল তখন তাদের বাপ (কেনানে) বললো, “আমি ইউসুফের গন্ধ পাচ্ছি, তোমরা যেন আমাকে একথা বলো না যে, বুড়ো বয়সে আমার বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়েছে৷”
﴿قَالُوا تَاللَّهِ إِنَّكَ لَفِي ضَلَالِكَ الْقَدِيمِ﴾
৯৫) ঘরের লোকরো বললো, “আল্লাহর কসম, আপনি এখনো নিজের সেই পুরাতন পাগলামি নিয়েই আছেন৷”
﴿فَلَمَّا أَن جَاءَ الْبَشِيرُ أَلْقَاهُ عَلَىٰ وَجْهِهِ فَارْتَدَّ بَصِيرًا ۖ قَالَ أَلَمْ أَقُل لَّكُمْ إِنِّي أَعْلَمُ مِنَ اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ﴾
৯৬) তারপর যখন সুখবর বহনকারী এলো তখন সে ইউসুফের জামা ইয়াকূবের চেহারার ওপর রাখলো এবং অকস্মাত তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে এলো৷ তখন সে বললো, “আমি না তোমাদের বলেছিলাম, আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন সব কথা জানি যা তোমরা জানো না ?”
﴿قَالُوا يَا أَبَانَا اسْتَغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا إِنَّا كُنَّا خَاطِئِينَ﴾
৯৭) সবাই বলে উঠলো, “আব্বাজান৷ আপনি আমাদের গুনাহ মাফের জন্য দোয়া করুন, সত্যিই আমরা অপরাধী ছিলাম৷”
﴿قَالَ سَوْفَ أَسْتَغْفِرُ لَكُمْ رَبِّي ۖ إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ﴾
৯৮) তিনি বললেন, “আমি আমার রবের কাছে তোমাদের মাগফেরাতের জন্য আবেদন জানাবো, তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও করুণাময়৷”
﴿فَلَمَّا دَخَلُوا عَلَىٰ يُوسُفَ آوَىٰ إِلَيْهِ أَبَوَيْهِ وَقَالَ ادْخُلُوا مِصْرَ إِن شَاءَ اللَّهُ آمِنِينَ﴾
৯৯) তারপর যখন তারা ইউসুফের কাছে পৌঁছুলো তখন সে নিজের বাপ-মাকে নিজের কাছে বসালো এবং (নিজের সমগ্র পরিবার পরিজনকে) বললো, “চলো, এবার শহরে চলো, আল্লাহ চাহেতো শান্তি ও নিরপত্তার মধ্যে বসবাস করবে৷”
﴿وَرَفَعَ أَبَوَيْهِ عَلَى الْعَرْشِ وَخَرُّوا لَهُ سُجَّدًا ۖ وَقَالَ يَا أَبَتِ هَٰذَا تَأْوِيلُ رُؤْيَايَ مِن قَبْلُ قَدْ جَعَلَهَا رَبِّي حَقًّا ۖ وَقَدْ أَحْسَنَ بِي إِذْ أَخْرَجَنِي مِنَ السِّجْنِ وَجَاءَ بِكُم مِّنَ الْبَدْوِ مِن بَعْدِ أَن نَّزَغَ الشَّيْطَانُ بَيْنِي وَبَيْنَ إِخْوَتِي ۚ إِنَّ رَبِّي لَطِيفٌ لِّمَا يَشَاءُ ۚ إِنَّهُ هُوَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ﴾
১০০) (শহরে প্রবেশ করার পর) সে নিজের বাপ-মাকে উঠিয়ে নিজের পাশে সিংহাসনে বসালো এবং সবাই তার সামনে স্বতস্ফূর্তভাবে সিজদায় ঝুঁকে পড়লো৷ ইউসুফ বললো, “আব্বাজান! আমি ইতিপুর্বে যে স্বপ্ন দেখেছিলাম এ হচ্ছে তার তা’বীর৷ আমার রব তাকে সত্য পরিণত করেছেন ৷ আমার প্রতি তাঁর অনুগ্রহ হিসেবে তিনি আমাকে কারাগার থেকে বের করেছেন এবং আপনাদেরকে মরু অঞ্চল থেকে এনে আমার সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন৷ আসলে আমার রব অননুভূত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ করেন৷ নিসন্দেহে তিনি সবকিছু জানেন ও সুগভীর প্রজ্ঞার অধিকারী৷
﴿رَبِّ قَدْ آتَيْتَنِي مِنَ الْمُلْكِ وَعَلَّمْتَنِي مِن تَأْوِيلِ الْأَحَادِيثِ ۚ فَاطِرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ أَنتَ وَلِيِّي فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ ۖ تَوَفَّنِي مُسْلِمًا وَأَلْحِقْنِي بِالصَّالِحِينَ﴾
১০১) হে আমার রব! তুমি আমাকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করেছো এবং আমাকে কথার গভীরে প্রবেশ করা শিখিয়েছো৷ হে আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টা! দুনিয়ায় ও আখেরাতে তুমিই আমার অভিভাবক৷ ইসলামের ওপর আমাকে মৃত্যু দান করো এবং পরিণামে আমাকে সৎকর্মপরায়ণদের অন্তরভূক্ত করো৷”
﴿ذَٰلِكَ مِنْ أَنبَاءِ الْغَيْبِ نُوحِيهِ إِلَيْكَ ۖ وَمَا كُنتَ لَدَيْهِمْ إِذْ أَجْمَعُوا أَمْرَهُمْ وَهُمْ يَمْكُرُونَ﴾
১০২) হে মুহাম্মদ! এ কাহিনী অদৃশ্যলোকের খবরের অন্তরভুক্ত, যা আমি তোমাকে অহীর মাধ্যমে জানাচ্ছি৷ নয়তো, তুমি তখন উপস্থিত ছিলে না যখন ইউসুফের ভাইয়েরা একজোট হয়ে যড়যন্ত্র করেছিল৷
﴿وَمَا أَكْثَرُ النَّاسِ وَلَوْ حَرَصْتَ بِمُؤْمِنِينَ﴾
১০৩) কিন্তু তুমি যতই চাওনা কেন অধিকাংশ লোক তা মানবে না৷
﴿وَمَا تَسْأَلُهُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ ۚ إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرٌ لِّلْعَالَمِينَ﴾
১০৪) অথচ তুমি এ খেদমতের বিনিময়ে তাদের কাছে কোন পারিশ্রমিকও চাচ্ছো না৷ এটা তো দুনিয়াবাসীদের জন্য সাধারণভাবে একটি নসীহত ছাড়া আর কিছুই নয়৷
﴿وَكَأَيِّن مِّنْ آيَةٍ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَمُرُّونَ عَلَيْهَا وَهُمْ عَنْهَا مُعْرِضُونَ﴾
১০৫) আকাশসমুহে ও পৃথিবীতে কত নিদর্শন রয়েছে, যেগুলো তারা অতিক্রম করে যায় কিন্তু সেদিকে একটুও দৃষ্টিপাত করে না৷
﴿وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُم بِاللَّهِ إِلَّا وَهُم مُّشْرِكُونَ﴾
১০৬) তাদের বেশীর ভাগ আল্লাহকে মানে কিন্তু তাঁর সাথে অন্যকে শরীক করে৷
﴿أَفَأَمِنُوا أَن تَأْتِيَهُمْ غَاشِيَةٌ مِّنْ عَذَابِ اللَّهِ أَوْ تَأْتِيَهُمُ السَّاعَةُ بَغْتَةً وَهُمْ لَا يَشْعُرُونَ﴾
১০৭) তারা কি এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে গেছে যে, আল্লাহর আযাবের কোন আকস্মিক আক্রমণ তাদেরকে গ্রাস করে নেবে না অথবা তাদের অজ্ঞাতসারে তাদের ওপর সহসা কিয়ামত এসে যাবে না ?
﴿قُلْ هَٰذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ ۚ عَلَىٰ بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي ۖ وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ﴾
১০৮) তাদেরকে পরিষ্কার বলে দাও : আমার পথতো এটাই, আমি আল্লাহর দিকে ডাকি, আমি নিজেও পূর্ণ আলোকে নিজের পথ দেখছি এবং আমার সাথীরাও৷ আর আল্লাহ পাক-পবিত্র এবং শিরককারীদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই৷
﴿وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ إِلَّا رِجَالًا نُّوحِي إِلَيْهِم مِّنْ أَهْلِ الْقُرَىٰ ۗ أَفَلَمْ يَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَيَنظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ ۗ وَلَدَارُ الْآخِرَةِ خَيْرٌ لِّلَّذِينَ اتَّقَوْا ۗ أَفَلَا تَعْقِلُونَ﴾
১০৯) হে মুহাম্মদ! তোমার পূর্বে আমি যে নবীদেরকে পাঠিয়েছিলাম তারা সবাই মানুষই ছিল, এসব জনবসতিরই অধিবাসী ছিল এবং তাদের কাছেই আমি অহী পাঠাতে থেকেছি৷ তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করেনি এবং তাদের পূর্বে যেসব জাতি চলে গেছে তাদের পরিণাম দেখেনি ? নিশ্চিতভাবেই আখেরাতের আবাস তাদের জন্য আরো বেশী ভালো যারা (নবীর কথা মেনে নিয়ে) তাকওয়ার পথ অবলম্বন করেছে৷ এখনো কি তোমরা বুঝবে না ?
﴿حَتَّىٰ إِذَا اسْتَيْأَسَ الرُّسُلُ وَظَنُّوا أَنَّهُمْ قَدْ كُذِبُوا جَاءَهُمْ نَصْرُنَا فَنُجِّيَ مَن نَّشَاءُ ۖ وَلَا يُرَدُّ بَأْسُنَا عَنِ الْقَوْمِ الْمُجْرِمِينَ﴾
১১০) (আগের নবীদের সাথেও এমনটি হতে থেকেছে৷ অর্থাৎ তারা দীর্ঘদিন উপদেশ দিয়ে গেছেন কিন্তু লোকেরা তাদের কথা শোনেনি৷) এমনকি যখন নবীরা লোকদের থেকে হতাশ হয়ে গেলো এবং লোকেরাও ভাবলো তাদেরকে মিথ্যা বলা হয়েছিল তখন অকস্মাত আমার সাহায্য নবীদের কাছে পৌঁছে গেলো৷ তারপর এ ধরনের সময় যখন এসে যায় তখন আমার নিয়ম হচ্ছে, যাকে আমি চাই তাকে রক্ষা করি এবং অপরাধীদের প্রতি আমার আযাব তো রদ করা যেতে পারে না৷
﴿لَقَدْ كَانَ فِي قَصَصِهِمْ عِبْرَةٌ لِّأُولِي الْأَلْبَابِ ۗ مَا كَانَ حَدِيثًا يُفْتَرَىٰ وَلَٰكِن تَصْدِيقَ الَّذِي بَيْنَ يَدَيْهِ وَتَفْصِيلَ كُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ﴾
১১১) পূর্ববর্তী লোকদের এ কাহিনীর মধ্যে বুদ্ধি ও বিবেচনা সম্পন্ন লোকদের জন্য শিক্ষা রয়েছে৷ কুরআনে এ যা কিছু বর্ণনা করা হচ্ছে এগুলো বানোয়াট কথা নয় বরং এগুলো ইতিপূর্বে এসে যাওয়া কিতাবগুলোতে বর্ণিত সত্যের সমর্থন এবং সবকিছুর বিশদ বিবরণ, আর যারা ঈমান এসেছে তাদের জন্য হেদায়াত ও রহমত ৷