নামকরণ
‘নূহ’ এ সূরার নাম। এর বিষয়বস্তুর শিরোনামও ‘নূহ’। কারণ এতে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত হযরত ‘নূহ’ আলাইহি সালামের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।
নাযিল হওয়ার সময়-কাল
এটিও রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কী জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে নাযিল হওয়া সূরা সমূহের অন্যতম। তবে এর বিষয়বস্তুর আভ্যন্তরীণ সাক্ষ থেকে ইংগিত পাওয়া যায় যে, যে সময় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত ও তাবলীগের বিরুদ্ধে মক্কার শত্রুতামূলক আচরণ বেশ তীব্রতা লাভ করেছিল তখন এ সূরাটি নাযিল হয়েছিল।
বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য
এতে হযরত নূহ আলাইহি সলামের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। তবে তা কেবল কাহিনী বর্ণনার উদ্দেশ্যে করা হয়নি।বরং এর উদ্দেশ্য মক্কার কাফেরদের এ মর্মে সাবধান করা যে, হযরত নূহ আলাইহিস সালামের সাথে তার কওম যে আচরণ করেছিল তোমরাও হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সে একই আচরণ করছো। তোমরা যদি এ আচরণ থেকে বিরত না হও তাহলে তোমাদের ও সে একই পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে যার সম্মুখীন হয়েছিল ঐ সব লোকেরা। গোটা সূরার মধ্যে একথাটি ষ্পষ্ট ভাষায় কোথাও বলা হয়নি। কিন্তু যে অবস্থা ও পরিস্থিতিতে মক্কীবাসীদের এ কাহিনী শুনানো হয়েছে তার পটভূমিতে এ বিষয়টি আপনা থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
যে সময় আল্লাহ তা’আলা হযরত নূহ আলাইহি সালামকে রিসালাতের পদ মর্যাদায় অভিসিক্ত করেছিলেন সে সময় তার ওপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন প্রথম আয়াতে তা বলা হয়েছে।
তিনি তাঁর দাওয়াত কিভাবে শুরু করেছিলেন এবং স্বজাতির মানুষের সামনে কি বক্তব্য পেশ করেছিলেন।
[important]২থেকে ৪ পর্যন্ত আয়াতে তা সংক্ষিপ্তকারে বলা হয়েছে, এরপর দীর্ঘকাল পর্যন্ত দীনের দাওয়াত ও তাবলীগের জন্য অবর্ণনীয় দুঃখ -কষ্ট বরণ করার পর তার যে বর্ণনা হযরত নূহ আলাইহি সালাম আল্লাহর দারবারে পেশ করেছিলেন ৫ থেকে ২০ আয়াতে তা বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি তাঁর জাতিকে সত্য পথে আনার জন্য কিভাবে চেষ্টা-সাধনা করেছেন আর তার জাতির লোকেরা কি রকম হঠকারীতার মাধ্যমে তার বিরোধীতা করেছে এ পর্যায়ে তিনি তার সবই তাঁর প্রভূর সামনে পেশ করেছেন।[/important]
[important]এরপর ২১ থেকে ২৪ আয়াতে হযরত নূহ আলাইহিস সালামের শেষ আবেদনের বিষয়, উল্লেখ করা হয়েছে। এতে তিনি মহান আল্লাহর কাছে এ মর্মে আবেদন করেছেন যে, এ জাতি আমার দাওয়াত চূড়ান্তভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।এরা তাদের নেতাদের হাতে নিজেদের লাগাম তুলে দিয়েছে এবং বিরাট ও ব্যাপক ষড়যন্ত্র-জাল বিস্তার করেছে। এখন তাদের থেকে হিদায়াত গ্রহণ করার শুভবুদ্ধি ও যোগ্যতা ছিনিয়ে নেয়ার সময় এসে গেছে। হযরত নূহ আলাইহিস সালামের পক্ষ থেকে এটা কোন প্রকার অধৈর্যের বর্হিপ্রকাশ ছিল না। বরং শত শত বছর ধরে ধৈর্যের চরম পরীক্ষার মত পরিবেশ -পরিস্থিতির মধ্যে দীনের তাবলীগের দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার পর যে সময় তিনি তাঁর কওমের ব্যাপারে পুরোপুরি নিরাশ হয়ে গেলেন কেবল তখনই তিনি এ সিদ্ধান্তে পৌছলেন যে, এখন এ জাতির সত্য ও ন্যায়ের পথে আসার আর কোন সম্ভাবনাই নেই। তার এ সিদ্ধান্ত ছিল হুবুহু আল্লাহ তা’আলার ফায়সালার অনুরূপ। তা-ই এর পরবর্তী ২৫ আয়াতেই বলা হয়েছে। এ জাতির কৃতকর্মের কারণে তাদের ওপর আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে আযাব নাযিল হলো।[/important]
আযাব নাযিল হওয়ার ঠিক পূর্ব মূহূর্তে হযরত নূহ আলাইহস সালাম আল্লাহ তা’আলার কাছে যে দোয়া করেছিলেন শেষ আয়াতটিতে তা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে তিনি নিজের ও ঈমানদারদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন এবং নিজ কওমের কাফেরদের জন্য এ মর্মে আল্লাহর কাছে আবেদন করছেন যেন তাদের কাউকেই পৃথিবীর বুকে বসবাস করার জন্য জীবিত রাখা না হয়, কারণ , তাদের মধ্যে এখন আর কোন কল্যাণই অবশিষ্ট নেই। তাই তাদের ঔরসে এখন যারাই জন্মলাভ করেবে তারাই কাফের এবং পাপী হিসেবেই বেড়ে উঠবে।
এ সূরা অধ্যায়নকালে ইতিপর্বে কুরআন মজীদে হযরত নূহ আলাইহিস সালামের কাহিনীর যে বিস্তারিত ব্যাখ্যা পেশ করা হয়েছে তাও সামনে থাকা দরকার। দেখুন, সূরা আল আ’রাফ, আয়াত ৫৯ থেকে ৬৪; সূরা ইউনুস, ৭১ থেকে ৭৩; সূরা হুদ , ২৫ থেকে ৪৯; সূরা আল মু’মিনূন ,২৩ থেকে ৩১; সূরা আশ শু’আরা ,১০৫ থেকে ১২২; সূরা আল আনকাবুত, ১৪ ও ১৫ , সূরা আস সাফ্ফাত,৭৫ থেকে ৮২ এবং সূরা আল কামার, ৯ থেকে ১৬ আয়াত পর্যন্ত।
﴿بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ إِنَّا أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَىٰ قَوْمِهِ أَنْ أَنذِرْ قَوْمَكَ مِن قَبْلِ أَن يَأْتِيَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾
১) আমি নূহকে তার জাতির কাছে পাঠিয়েছিলাম (এ নির্দেশ দিয়ে) যে , একটি কষ্টদায়ক আযাব আসার আগেই তুমি তাদেরকে সাবধান করে দাও ৷
﴿قَالَ يَا قَوْمِ إِنِّي لَكُمْ نَذِيرٌ مُّبِينٌ﴾
২) সে বললো, হে আমার জাতি ,আমি তোমাদের জন্য একজন সতর্ককারী
﴿أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاتَّقُوهُ وَأَطِيعُونِ﴾
৩) (বার্তাবাহক , আমি তোমাদের জানিয়ে দিচ্ছি) যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করো, তাঁকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো,
﴿يَغْفِرْ لَكُم مِّن ذُنُوبِكُمْ وَيُؤَخِّرْكُمْ إِلَىٰ أَجَلٍ مُّسَمًّى ۚ إِنَّ أَجَلَ اللَّهِ إِذَا جَاءَ لَا يُؤَخَّرُ ۖ لَوْ كُنتُمْ تَعْلَمُونَ﴾
৪) আল্লাহ তোমাদের গোনাহ মাফ করে দেবেন এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমাদের অবকাশ দেবেন৷ প্রকৃত ব্যাপার হলো, আল্লাহর নির্ধারিত সময় যখন এসে যায় তখন তা থেকে বাঁচা যায় না৷ আহ্! যদি তোমরা তা জানতে৷
﴿قَالَ رَبِّ إِنِّي دَعَوْتُ قَوْمِي لَيْلًا وَنَهَارًا﴾
৫) সে বললোঃ হে আমার বর, আমি আমার কওমের লোকদের রাতদিন আহবান করেছি৷
﴿فَلَمْ يَزِدْهُمْ دُعَائِي إِلَّا فِرَارًا﴾
৬) কিন্তু আমার আহবান তাদের দূরে সরে যাওয়াকে কেবল বাড়িয়েই তুলেছে৷
﴿وَإِنِّي كُلَّمَا دَعَوْتُهُمْ لِتَغْفِرَ لَهُمْ جَعَلُوا أَصَابِعَهُمْ فِي آذَانِهِمْ وَاسْتَغْشَوْا ثِيَابَهُمْ وَأَصَرُّوا وَاسْتَكْبَرُوا اسْتِكْبَارًا﴾
৭) তুমি যাতে তাদের ক্ষমা করে দাও এ উদ্দেশ্যে আমি যখনই তাদের আহবান করেছি তখনই তারা কানে আঙুল দিয়েছে, এবং কাপড় দিয়ে মুখ ঢেলে নিয়েছে, নিজেদের আচরণে অনড় থেকেছে এবং অতি মাত্রায় ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছে৷
﴿ثُمَّ إِنِّي دَعَوْتُهُمْ جِهَارًا﴾
৮) অতপর আমি তাদেরকে উচ্চকণ্ঠে আহবান জানিয়েছি৷
﴿ثُمَّ إِنِّي أَعْلَنتُ لَهُمْ وَأَسْرَرْتُ لَهُمْ إِسْرَارًا﴾
৯) তারপর প্রকাশ্যে তাদের কাছে তাবলীগ করেছি এবং গোপনে চুপে চুপে বুঝিয়েছি৷
﴿فَقُلْتُ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ إِنَّهُ كَانَ غَفَّارًا﴾
১০) আমি বলেছি তোমরা নিজেদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা চাও ৷ নিসন্দেহে তিনি অতিশয় ক্ষমাশীল৷
﴿يُرْسِلِ السَّمَاءَ عَلَيْكُم مِّدْرَارًا﴾
১১) তিনি আকাশ থেকে তোমাদের ওপর প্রচুর বৃষ্টি বর্ষাবেন৷
﴿وَيُمْدِدْكُم بِأَمْوَالٍ وَبَنِينَ وَيَجْعَل لَّكُمْ جَنَّاتٍ وَيَجْعَل لَّكُمْ أَنْهَارًا﴾
১২) সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি দিয়ে সাহায্য করবেন, তোমাদের জন্য বাগান সৃষ্টি করবেন আর নদী-নালা প্রবাহিত করে দিবেন৷
﴿مَّا لَكُمْ لَا تَرْجُونَ لِلَّهِ وَقَارًا﴾
১৩) তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর মাহাত্ম্য, শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা আছে বলে মনে করছো না৷
﴿وَقَدْ خَلَقَكُمْ أَطْوَارًا﴾
১৪) অথচ তিনিই তোমাদের পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি করেছেন৷
﴿أَلَمْ تَرَوْا كَيْفَ خَلَقَ اللَّهُ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ طِبَاقًا﴾
১৫) তোমরা কি দেখ না, আল্লাহ কিভাবে সাত স্তরে বিন্যাস্ত করে আসমান সৃষ্টি করেছেন?
﴿وَجَعَلَ الْقَمَرَ فِيهِنَّ نُورًا وَجَعَلَ الشَّمْسَ سِرَاجًا﴾
১৬) ওগুলোর মধ্যে চাঁদকে আলো এবং সূর্যকে প্রদীপ হিসেবে স্থাপন করেছেন৷
﴿وَاللَّهُ أَنبَتَكُم مِّنَ الْأَرْضِ نَبَاتًا﴾
১৭) আল্লাহ তা”আলা তোমাদেরকে মাটি থেকে বিস্ময়কর রূপে উৎপন্ন করেছেন৷
﴿ثُمَّ يُعِيدُكُمْ فِيهَا وَيُخْرِجُكُمْ إِخْرَاجًا﴾
১৮) আবার এ মাটির মধ্যে তোমাদের ফিরিয়ে নেবেন৷ এবং অকস্মাৎ এ মাটি থেকেই তোমাদের বের করে আনবেন৷
﴿وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ بِسَاطًا﴾
১৯) আল্লাহ ভূপৃষ্ঠকে তোমাদের জন্য বিছানার মত করে পেতে দিয়েছেন৷
﴿لِّتَسْلُكُوا مِنْهَا سُبُلًا فِجَاجًا﴾
২০) যেন তোমরা এর প্রশস্ত পথে চলতে পার৷
﴿قَالَ نُوحٌ رَّبِّ إِنَّهُمْ عَصَوْنِي وَاتَّبَعُوا مَن لَّمْ يَزِدْهُ مَالُهُ وَوَلَدُهُ إِلَّا خَسَارًا﴾
২১) নূহ বললোঃ হে প্রভু,তারা আমার কথা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ঐ সব নেতার অনুসরণ করেছে যারা সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি পেয়ে আরো বেশী ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে৷
﴿وَمَكَرُوا مَكْرًا كُبَّارًا﴾
২২) এসব লোক সাংঘাতিক ষড়যন্ত্র -জাল বিস্তার করে রেখেছে৷
﴿وَقَالُوا لَا تَذَرُنَّ آلِهَتَكُمْ وَلَا تَذَرُنَّ وَدًّا وَلَا سُوَاعًا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسْرًا﴾
২৩) তারা বলেছে,তোমরা নিজেদের দেব-দেবীদের কোন অবস্থায় পরিত্যাগ করো না৷ আর ওয়াদ, সুওয়া’আ, ইয়াগুস,ইয়াউক,এবং নাসরকেও পরিত্যাগ করো না৷
﴿وَقَدْ أَضَلُّوا كَثِيرًا ۖ وَلَا تَزِدِ الظَّالِمِينَ إِلَّا ضَلَالًا﴾
২৪) অথচ এসব দেব-দেবী বহু লোককে গোমরাহীতে নিক্ষেপ করেছে৷ তুমিও এসব জালেমদের জন্য গোমরাহী ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করো না৷
﴿مِّمَّا خَطِيئَاتِهِمْ أُغْرِقُوا فَأُدْخِلُوا نَارًا فَلَمْ يَجِدُوا لَهُم مِّن دُونِ اللَّهِ أَنصَارًا﴾
২৫) নিজেদের অপরাধের কারণেই তাদের নিমজ্জিত করা হয়েছিল তারপর আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করা হয়েছিল৷ অতপর তারা আল্লাহর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কোন সাহায্যকারী পায়নি৷
﴿وَقَالَ نُوحٌ رَّبِّ لَا تَذَرْ عَلَى الْأَرْضِ مِنَ الْكَافِرِينَ دَيَّارًا﴾
২৬) আর নূহ বললোঃ হে আমার রব, এ কাফেরদের কাউকে পৃথিবীর বুকে বসবাসের জন্য রেখো না৷
﴿إِنَّكَ إِن تَذَرْهُمْ يُضِلُّوا عِبَادَكَ وَلَا يَلِدُوا إِلَّا فَاجِرًا كَفَّارًا﴾
২৭) তুমি যদি এদের ছেড়ে দাও তাহলে এরা তোমার বান্দাদের বিভ্রান্ত করবে এবং এদের বংশে যারাই জন্মলাভ করবে তারাই হবে দুষ্কৃতকারী ও কাফের৷
﴿رَّبِّ اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِمَن دَخَلَ بَيْتِيَ مُؤْمِنًا وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَلَا تَزِدِ الظَّالِمِينَ إِلَّا تَبَارًا﴾
২৮) হে আমার রব, আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে,যারা মু”মিন হিসেবে আমার ঘরে প্রবেশ করেছে তাদেরকে এবং সব মু”মিন নারী-পুরুষকে ক্ষমা করে দাও৷ জালেমদের জন্য ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করো না৷